স্যাটেলাইট রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বের সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সর্বকালের সর্বোচ্চে স্তরে পৌঁছেছে, যার ফলে বিশ্বজুড়ে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন সরকারের রেকর্ড সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়াএ) থেকে প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে যে এপ্রিলের শুরু থেকে সমুদ্রের পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ২১.১ সেন্টিগ্রেডে রয়েছে। নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যাথিউ ইংল্যান্ড বলেছেন, “বর্তমান গতিপথ দেখে মনে হচ্ছে এটি আগের রেকর্ডগুলিকে ভেঙে দিয়েছে।” বিশাল গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে তিন বছরের লা নিনা অবস্থা তাপমাত্রাকে দমন করতে সাহায্য করেছে এবং ক্রমবর্ধমান গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রভাবকে কমিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে তাপ এখন সমুদ্রের পৃষ্ঠে বাড়ছে, এই বছরের শেষের দিকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে একটি সম্ভাব্য এল নিনো প্যাটার্নের দিকে ইঙ্গিত করে যা চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী তাপ রেকর্ডকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। নোয়া-এর একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী ডাঃ মাইক ম্যাকফ্যাডেন বলেছেন: “সাম্প্রতিক ‘ট্রিপল ডিপ’ লা নিনা শেষ হয়ে গেছে। বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি সত্ত্বেও এই দীর্ঘস্থায়ী ঠাণ্ডা বিশ্বব্যাপী গড় পৃষ্ঠের তাপমাত্রাকে কমিয়ে দিচ্ছে। সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তনের সংকেতটি আরো স্পষ্টভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। লা নিনা সময়কাল – মধ্য এবং পূর্ব গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে শীতল এবং শক্তিশালী বায়ু দ্বারা চিহ্নিত করা হয় – বিশ্ব তাপমাত্রার উপর শীতল প্রভাব ফেলে এই বায়ু। এল নিনোর সময়কালে, এই অঞ্চলে সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ থাকে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। নোয়ার তথ্য অনুসারে, দ্বিতীয়-উষ্ণতম বিশ্বব্যাপী গড় সমুদ্রের তাপমাত্রা এল নিনোর সাথে মিলে যায় যা ২০১৪থেকে ২০১৬ পর্যন্ত চলেছিল।
এই ডেটা বেশিরভাগ স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ দ্বারা নথিভুক্ত করা হয়। তবে জাহাজ থেকে পরিমাপের মাধ্যমেও এটি যাচাই করা হয়। ডেটা মেরু অঞ্চলগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে না। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো এবং বনাঞ্চল ধ্বংসের জেরে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস যুক্ত হয়েছে। এর ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত তাপের ৯০% এরও বেশি সমুদ্র গ্রহণ করেছে।
গত বছরের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে সমুদ্রে জমা হওয়া তাপের পরিমাণ ত্বরান্বিত এবং গভীরে প্রবেশ করছে, যা চরম আবহাওয়ার পরিবেশ তৈরী করছে। গবেষণার একজন সহ-লেখক ইংল্যান্ড বলেছেন: “আমরা এখন যা দেখছি [সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার রেকর্ড সহ] তা হল প্রবল উষ্ণতার উত্থান যা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত।” ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক রিসার্চের জলবায়ু বিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত ডঃ কেভিন ট্রেনবার্থ বলেছেন, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে তাপ ১০০ মিটারেরও বেশি নিচে প্রসারিত হচ্ছে।যদিও সামুদ্রিক তাপপ্রবাহগুলি স্থানীয় আবহাওয়ার দ্বারা চালিত হতে পারে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে সমুদ্রগুলি উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে তা বৈশ্বিক উত্তাপের ওপর আরো খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। উত্তপ্ত মহাসাগরগুলি ঝড়ের জন্য আরও শক্তি সরবরাহ করে, সেইসাথে বরফের শীটগুলিকে গলাতে শুরু করে , বিশ্বব্যাপী সমুদ্রের স্তরকে বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে। সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ সামুদ্রিক প্রাণীর উপরও বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারে এবং প্রবাল প্রাচীরগুলি নষ্ট করে দিতে পারে। পরীক্ষায় আরো দেখা গেছে যে উষ্ণতা সাগরের খাদ্যের শৃঙ্খলাকে আমূল পরিবর্তন করে শৈবালের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। মোনাশ ইউনিভার্সিটির একজন জলবায়ু বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক ডাইটমার ডোমেনগেট বলেছেন- ” মানব সৃষ্ট বৈশ্বিক উত্তাপের সংকেত মহাসাগরের বুকে অনেক বেশি পরিষ্কার। স্পষ্টতই আমরা একটি দ্রুত-উষ্ণ জলবায়ু প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি এবং আমরা উষ্ণতার একটি নতুন রেকর্ড দেখতে পাবো। যা এল নিনোর পূর্বাভাস দিচ্ছে। যদি এটি ঘটে, আমরা কেবল সমুদ্রে নয়, স্থলভাগেও তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড দেখতে পাব।”