‘ঈদের পর আন্দোলন’- বিএনপি’র এই ঘোষণা নিয়ে ট্রল হয়েছে অনেক। তবে আরেকটি ঈদের পর সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের রাজনীতি একটি টার্নিং পয়েন্টের দিকে যাচ্ছে। ঢাকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনী বছরে প্রতিটি দিনই হবে গুরুত্বপূর্ণ। পর্দার আড়ালে, রাজনীতির মাঠে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাকর মুহূর্ত সামনে। এরইমধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমান। ব্লিনকেন-মোমেন বৈঠকের পর চলছে দৌড়ঝাঁপ। দুই শিবিরই তৎপর। আন্তর্জাতিক দুনিয়া অবশ্য বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের বার্তা স্পষ্ট, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক ছাড়া কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা হিসাবনিকাশ।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে দফায় দফায় নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কোনো দেশের ক্ষমতা পাল্টাতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, বিদেশিদের তৎপরতার কারণে সরকার চাপে পড়েছে। এ কারণে তারা নানা কথা বলছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বিরোধী দলগুলোরও তৎপরতা বেড়েছে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনের আগেই সরকারের পদত্যাগ এবং একটি নির্দলীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। দলটির নেতারা বলছেন, নির্দলীয় সরকার না হলে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। তারা এও বলছেন, আন্দোলনের মাধ্যমেই এই দাবি আদায় করা হবে। দলটির সূত্র বলছে, নতুন বছরের শুরু থেকেই নানা কর্মসূচি পালন করা হলেও ঈদের পর কর্মসূচি জোরালো হতে পারে। ক্রমে তাদের আন্দোলন এক দফায় রূপ নিতে পারে। বিএনপি’র সঙ্গে সমমনা যেসব দল যুগপৎ আন্দোলন করছে তারাও আন্দোলন কর্মসূচির ছক কষছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির অবস্থান স্পষ্ট নয়। তবে দলটির সূত্র বলছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় পার্টি এবার নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। বিরোধী দলগুলোর সম্ভাব্য আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে আওয়ামী লীগও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যে দলের তৃণমূলের কার্যক্রম প্রায় শেষ হয়েছে। বিরোধী দলের কর্মসূচির বিপরীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। বিরোধীদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করছে নিয়মিত। এ ধরনের সমাবেশ আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত করা হবে বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রাজনৈতিক সফর শুরু করেছেন। ঈদের পর তিনি পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করবেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
আন্দোলনে চোখ বিএনপি’র: গত ৪ মাস ধরে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে অটল দলটির নেতাকর্মীরা। এদিকে ঘনিয়ে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখনই চলমান আন্দোলনে গতি ফেরাতে চায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। চায় একদফার আন্দোলনও। এজন্য ঈদের পর পুরোদমে মাঠে নামবে দলগুলোর নেতারা। এরই মধ্যে নানা প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। গত চার মাসের আন্দোলনকে ‘টেস্ট ম্যাচ’ ধরে নতুন আঙ্গিকে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামছে সরকারবিরোধীরা। নেতারা বলছেন, জুন-জুলাই নাগাদ ‘সর্বাত্মক’ সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নিবে। রাজপথেই ‘গণঅভ্যুত্থান’ ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিএনপি একদিকে কঠোর আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। নিয়মিত যোগাযোগ বাড়ছে কূটনীতিক পাড়ায়। সম্প্রতি ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর সরগরম রাজনীতির মাঠ। নতুন করে আশার সঞ্চার করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
বিএনপি’র নেতাকর্মীরা বলছেন- রমজান মাসের কারণে চলমান যুগপৎ আন্দোলন কিছুটা গতি হারিয়েছে। এখন নতুন করে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দিবে বিএনপি। আগামী ১লা মে শ্রমিক দিবসে কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মাঠে মানবে দলটি। এরপর ধারাবাহিকভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কর্মসূচি দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে রোডমার্চ, লংমার্চের মতো কর্মসূচি ঘোষণা হতে পারে। সিটি নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে ঈদুল আজহা পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন করবে বিএনপি। কোরবানি ঈদের পর এক দফার আন্দোলনে যাবে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।
বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফার দাবিতে আন্দোলন চলমান রয়েছে। রমজান মাসেও সারা দেশে আন্দোলন অব্যাহত ছিল। আগামীতে আরও কঠোর কর্মসূচি আসবে। জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দলের হাইকমান্ড পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় চেপে বসেছে। সহজে বিদায় নিবে না। আন্দোলনের মধ্যদিয়েই গণঅভ্যুত্থান ঘটানো হবে। ঈদের পর আন্দোলন আরও গতিশীল হবে। তবে কী কী কর্মসূচি আসবে- এখনই বলা যাচ্ছে না। বিএনপি’র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আগামী মাস থেকে কঠোর আন্দোলন করবে বিএনপি।
নির্বাচন পর্যন্ত শান্তি সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ভিন্ন আঙ্গিকে রাজপথে থাকবে আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে ‘শান্তি সমাবেশ’ করলেও এখন থেকে এ কর্মসূচি নিয়মিত পালন করার পরিকল্পনা করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। দলটি মনে করছে, যেকোনো ধরনের আন্দোলনের বিরুদ্ধে শান্তি সমাবেশ একটা কার্যকর পদক্ষেপ হবে। কারণ এটা জনগণের কাছে একটা মনস্তাত্ত্বিক শক্তি জোগাচ্ছে। আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, বিএনপি’র সরকারবিরোধী কর্মসূচি মানেই জ্বালাও পোড়াও আর আতঙ্কের। এসব থেকে জনগণকে রেহাই দিতে শান্তি সমাবেশ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো শান্তি সমাবেশ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ২০ থেকে ২৫ দিন শান্তি সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। এসব কর্মসূচি নিয়ে পরে দলীয়ভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে শান্তি সমাবেশকে জনসাধারণ ও দলীয় নেতাকর্মীরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছে। তাই আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর যেকোনো ধরনের কর্মসূচির বিপরীতে শান্তি সমাবেশ করে যথাযথ জবাব দেয়া হবে। গত ১১ই ফেব্রুয়ারি প্রতিটি জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে একযোগে ‘বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য ও সহিংসতার প্রতিবাদে’ শান্তি সমাবেশ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ উপলক্ষে দেশের ৪০ জেলায় যান আওয়ামী লীগের ৫৩ কেন্দ্রীয় নেতা। ৪ঠা মার্চ ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানায় শান্তি সমাবেশ করে দলটি। ওই কর্মসূচিতে মহানগরের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা যোগ দেন।
নির্বাচন পর্যন্ত শান্তি সমাবেশ অব্যাহত রাখা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যেই থাকে। মূল লক্ষ্য মানুষকে সম্পৃক্ত করে দলের আদর্শিক রাজনীতি অব্যাহত রাখা। দল গোছানো। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শান্তি সমাবেশ, জনসভা, কর্মিসভা সব সময় চলমান আছে, থাকবে। তিনি বলেন, আমরা যেহেতু ভোট পলিটিক্স করি সেহেতু আমাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণকে সম্পৃক্ত রেখে তাদের সমর্থনটা আমাদের পক্ষে রাখা। এজন্য যে ধরনের কর্মসূচি আমাদের রাখা দরকার সেটাই রাখি। বিএনপি’র আন্দোলনের বিপরীতে আমরা জনগণকে বার্তা দিতে চাই-ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, শান্তিশৃঙ্খলা অক্ষুণœ রাখার জন্যই আমাদের শান্তি সমাবেশ। শান্তি মিছিল। এর সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী কর্মকা-ও কিন্তু চালাচ্ছি। আমাদের শান্তি সমাবেশের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ধরে রাখার জন্য। এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ সরকারের যে রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে সেটা বাস্তবায়নের জন্য। সবকিছু হচ্ছে আগামী নির্বাচনে সাধারণ মানুষের মন জয়ের জন্য। তিনি বলেন, এ ধরনের শান্তি সমাবেশ চলবে। ভবিষ্যতে হয়তো নামে পরিবর্তন আসবে। যেমন-শান্তি সমাবেশ, শান্তি আন্দোলন হতে পারে, শান্তি সংগ্রাম হতে পারে। প্রয়োজন হলে এরকম নামের ভাবনা রয়েছে। মূল কথা-জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তাকে জোরদার করতেই এসব করবে আওয়ামী লীগ। একই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, বিএনপি যখন কর্মসূচি দেয় তখন জনমনে আতঙ্ক দেখা দেয়। জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের দায়বদ্ধতা রয়েছে। আর তাই বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংসতা তা-বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শান্তি সমাবেশ দিয়ে আওয়ামী লীগ রাজপথে সরব রয়েছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মো. রিয়াজউদ্দিন রিয়াজ বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত শান্তি সমাবেশের নামে রাজনীতির মাঠে পাহারাদার হিসেবে ভূমিকা পালন করবে আওয়ামী লীগ। সন্ত্রাস ও জ্বালাও পোড়াও করে কেউ যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন দলের নেতারা।