বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের এই অঞ্চলের ৩ বিলিয়ন মানুষের বাজার পেতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) দু’দিনব্যাপী কমনওয়েলথ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম-২০২৩-এর জমকালো উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই আহ্বান জানান। বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বাজারের কেন্দ্রস্থলে। এ ছাড়া আমাদের রয়েছে ১৭ কোটি মানুষ। যার বৃহৎ অংশ যুবসমাজ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সচ্ছল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি। ফলে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাজারে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
সরকার প্রধান বলেন, ‘এই আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ অন্যান্য কমনওয়েলথভুক্ত দেশের উন্নয়ন যাত্রায় অংশ নিতে আগ্রহী দেশ, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে পুনঃবিনিয়োগ থেকে। এ থেকে প্রমাণ হয় বাংলাদেশে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ বিদ্যমান। তিনি বলেন, আমি মনে করি যে, দু’দিনব্যাপী এই ফোরামে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অর্জন ও গতিশীল শিল্প খাতের সম্ভাবনাসমূহ তুলে ধরা এবং প্রতিশ্রুতিশীল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগ বিকাশের লক্ষ্য আরও প্রসারিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার চেষ্টা করছি, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ করার পরিবেশকে আরও সহজ করে তুলবে।’
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের ওপর তিনি সর্বদা গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কমনওয়েলথের বিজনেস-টু-বিজনেস (বিটুবি) কানেকটিভিটি ক্লাস্টার-এর লিড কান্ট্রি হিসেবে নেতৃত্ব প্রদান করছে এবং আন্তঃকমনওয়েলথ বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা ২ ট্রিলিয়ন ডলার অর্জনে কমনওয়েলথ ও সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে।
এ ছাড়া বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে কমনওয়েলথ সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে কাগজবিহীন (পেপারলেস) বাণিজ্য সুবিধা সংক্রান্ত আইনি কাঠামো প্রণয়নে সহায়তা প্রদানের জন্য ‘লিগ্যাল রিফর্ম অ্যান্ড ডিজিটাইজেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করা যেতে পারে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রয়োজন অধিকতর টেকসই বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বিকাশের পূর্বশর্ত হিসেবে আমার সরকার যে কার্যক্রমগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করেছে, তা হলো সাংগঠনিক সংস্কার, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ গঠন, বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং বিনিয়োগ পরবর্তী সেবা নিশ্চিতকরণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য প্রায় সকল খাতই উন্মুক্ত।
তবে এর মধ্যে কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুত, চিকিৎসা উপকরণ, গাড়ি ও জাহাজ নির্মাণ, তথ্য প্রযুক্তিসহ অনেক খাতে অধিক বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তিনি বলেন ‘এ সকল খাতে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি ব্যবসা হতে উদ্ভূত লাভ/ডিভিডেন্ড নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সহজতর করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগকারীদের কাছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে বিডা অনলাইনভিত্তিক ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। এর মাধ্যমে ২৬টি সংস্থার ৭৮টি সেবা একটি প্ল্যাটফরম থেকে দেয়া হচ্ছে।
‘বিনিয়োগের পূর্ব শর্ত হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন’ উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, এজন্য আমরা সমগ্র দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ১০৯টি হাইটেক পার্ক এবং সফটওয়্যার প্রযুক্তি পার্ক এবং আইটি প্রশিক্ষণ এবং ইনকিউবিউশন সেন্টার স্থাপন করছি। যেখানে বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, আমাদের সড়ক, রেল এবং আকাশপথে যোগাযোগ উন্নত হচ্ছে। দেশের প্রায় সকল মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে বা হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা সরাসরি রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে শিগগিরই ঢাকার সঙ্গে খুলনার রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে যা মোংলা বন্দর পর্যন্ত সমপ্রসারিত হবে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল চালু হবে শিগরিরই। চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন শহর কক্সবাজারে রেললাইন নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ঢাকায় গত বছর মেট্রোরেলের একাংশ এবং কয়েকদিন আগে দেশের প্রথম এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ উদ্বোধন করা হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এসব অবকাঠামোর পুরো অংশ চালু হলে ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ট্রাফিক জ্যামে আর কাউকে বসে থাকতে হবে না।
কমনওয়েলথ এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কাউন্সিল (সিডব্লিউইআইসি), বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জেডআই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিডব্লিউইআইসি চেয়ারম্যান লর্ড মারল্যান্ড। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া এবং স্ট্র্যাটেজিক এডভাইজার অব কমনওয়েলথ কান্ট্রিস অ্যান্ড বিয়ন্ড জিল্লুর হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে টেকসই, পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ প্রচারের লক্ষ্যে ২০২২ সালে প্রবর্তিত দ্বিতীয় ‘কমনওয়েলথ-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। উগান্ডার ‘ইকো ব্রিকস’ এই পুরস্কারটি জিতে নেয়। ইকো ব্রিকসের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন।
শুরুতেই বাংলাদেশে কমনওয়েলথ ব্যবসা এবং সুযোগ নিয়ে একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা ১২টিরও বেশি সেশনে অংশ নিচ্ছেন। কমনওয়েলথ হলো ৫৬টি দেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যা সাধারণ মূল্যবোধ দ্বারা একত্রিত এবং বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের আবাসস্থল। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথের ৩৪তম সদস্য হিসেবে যোগদান করে।
‘অব্যাহত এবং টেকসই জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিতকরণের জন্য বাণিজ্য ও জলবায়ুর প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেকসই পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও কমনওয়েলথের যৌথ উদ্যোগে ২০২২ সাল থেকে প্রদান করা হচ্ছে ‘কমনওয়েলথ-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড।’ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে এই পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং মানুষকে উৎসাহিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার যোগ্যতাও ২০২১ সালে অর্জন করেছে, যার বাস্তবায়ন ২০২৬ সাল থেকে শুরু হবে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০৬ সালে জিডিপি’র পরিমাণ ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে (২০২২ পর্যন্ত) তা পৌনে আট গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। সরকার প্রধান বলেন, পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। চাল, সবজি, ফল, মাছ, মাংস এবং ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সে লক্ষ্য অর্জনের পর আমরা কাজ করছি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের। স্মার্ট সরকার, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে।
দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের সেবা প্রদান, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন খণ্ডচিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত স্মার্ট দেশে এবং ২১০০ সালের মধ্যে টেকসই বদ্বীপে পরিণত হওয়ার। সে লক্ষ্যে আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
আন্তর্জাতিক সংকটেও দেশে খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, খাদ্যে এ স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান আন্তর্জাতিক সংকটেও দেশে খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত আছে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও সরকার তা নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের ওপর এর প্রভাব প্রশমনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর-পর্বে এ কথা জানান তিনি। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কোভিড অতিমারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে খাদ্যপণ্যসহ সবক্ষেত্রে যোগানব্যবস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সংকট মোকাবিলার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সরকার প্রতিনিয়ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে সংসদনেতা বলেন, কৃষি গবেষণা, সমপ্রসারণ ও কৃষি ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উপকরণ ও নীতি সহায়তার ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের প্রশ্নের লিখিত উত্তরে প্রধানমন্ত্রী জানান, পাবনায় নির্মাণাধীন দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সালের মধ্যে চালু হবে। ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণাধীন এবং দরপত্র প্রক্রিয়াধীনসহ মোট ১৪ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শেখ হাসিনা জানান, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। ১১ হাজার ৬০৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৩-২০২৬ সালের মধ্যে এগুলো পর্যায়ক্রমে চালু হবে। ২ হাজার ৪২৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি চালু হবে বলে আশা করা যায়। তিনি আরও জানান, বর্তমান সরকার বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে দেশে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে চলছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লক্ষ্যে জ্বালানি বহুমুখীকরণ অর্থাৎ গ্যাস বা এলএনজি, কয়লা, বিদ্যুৎ আমদানি, তরল জ্বালানি, নিউক্লিয়ার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ পরিকল্পনাগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়নের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে আজ ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াটে (ক্যাপটিভ, অফ-গ্রিড নবায়নযোগ্য ও জীবাশ্ম জ্বালানিসহ) উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, আমদানি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, অনেকগুলো দেশ নিজ নিজ দেশের গণহত্যাকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানায়। পরে আলোচনার মাধ্যমে ২০১৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৯ই ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যেহেতু ৯ই ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে, সেহেতু একই বিষয়ে আরও একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালনের প্রস্তাবটি সমীচীন হবে না। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষযক মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও কয়েকজন শহীদ পরিবারের সদস্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণহত্যা নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তি ও সংগঠনও বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করে যাচ্ছে। সংসদ নেতা জানান, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় পৃথিবীতে সংঘটিত অন্য যেকোনো গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় প্রক্রিয়ার মতোই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে, বন্ধুরাষ্ট্রসহ, গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি প্রদানের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় সহজ হবে। এ লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সরকারি দলের মামুনুর রশীদ কিরণের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৪১টি কোম্পানি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। বিভিন্ন জোনে ৫০টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব শিল্প থেকে এ পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্য উৎপাদন হয়েছে এবং ২৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই শিল্পগুলোতে প্রায় ৫০ হাজার জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জানান, বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে ৮৫৪ কিলোমিটার মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ, ১২ হাজার ৪৩৪ কিলোমিটার মহাসড়ক উন্নয়ন এবং এক লাখ ২৩ হাজার ২৫৪ মিটার দৈর্ঘ্যের এক হাজার ১৩১টি সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৫৭৪ কিলোমিটার মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ, ৪ হাজার ৬৩৪ কিলোমিটার মহাসড়ক উন্নয়ন এবং ৬৪ হাজার ৮৪৪ মিটার দৈর্ঘ্যের ৭৫০টি সেতু নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। আওয়ামী লীগের সৈয়দা রুবিনা আক্তারের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশের ৫৫ লাখ ৬১৭টি পরিবার, অর্থাৎ প্রায় ২৮ লাখ মানুষকে ঘর প্রদানের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে।