বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত। এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার ও সাক্ষী হলো ঢাকাবাসী। বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত, দমকা হাওয়া। মুহূর্তেই যেন নরকে পরিণত হয়ে পুরো শহর। আটকে যায় ঘরমুখী মানুষ। ডুবে যায় অলিগলি, মূল সড়ক। রাজধানীর কোথাও কোথাও সড়কে ভেঙে পড়ে গাছ। অশেষ ভোগান্তি। এমনিতেই ভোগান্তির শেষ নেই শহরে। সড়কে জ্যাম হয় মধ্যরাত পর্যন্ত।
যারা রাত ১০টায় বাসায় পৌঁছতেন অন্যদিন, কাল তাদের পেরিয়েছে রাত দেড়টা, ২টা।
এসবের মাঝেও এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। মিরপুরে কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত দিকে জলাবদ্ধ সড়কে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন একই পরিবারের চারজন। তাদের তিনজনই মারা গেছেন। ওই পরিবারের সাতমাস বয়সী এক শিশু গুরুতর অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এই পরিবারকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক তরুণ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় সামাজিকমাধ্যমে চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ, আহাজারি। প্রশ্ন উঠেছে এর দায় নেবে কে?
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এমনিতেই ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে রোজ তার ওপর এই মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না।
কার্যত পুরো রাজধানী অচল হয়ে পড়ে রাতের বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা আর যানজটে। অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে কর্মস্থল থেকে ঘরমুখী মানুষজনকে। টানা সাড়ে ছয়ঘন্টার ভারি বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে বিকল হয়ে যায় অনেক যানবাহন।
মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান, ফার্মগেট, তেজগাঁও, আজিমপুর, পলাশী, কামরাঙ্গীরচর, বাড্ডা, কুড়িল, গুলশান-১, গুলশান-২, পুলিশ প্লাজা, শ্যামলীসহ রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়।
জলাবদ্ধতায় সড়কগুলোতে সব গাড়ি আটকে যায়। প্রাইভেটকারের জানালা পর্যন্ত উঠে পানি।
মানিক নামের এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জানালেন, মতিঝিল থেকে রওনা দিয়েছি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে। ফার্মগেট এসে ১১টা বেজে যায়। গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। সেখান থেকে নেমে হাঁটা শুরু করি। মিরপুর পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সোয়া ১টা বেজে গেছে। চারদিকে পানি আর পানি।
রাত ১২টার দিকে গুলশান-১, ২ এলাকার অনেক বাসিন্দা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন সাহায্য চেয়ে। তাতে লিখেছেন, এখনো অনেকেই আটকে আছেন । গাড়ি পাচ্ছেন না। রাইড শেয়ারও মিলছে না। মোবাইলে চার্জ নেই। দু’একটা গাড়ি ফাঁকা পেলেও তিন থেকে চারগুণ ভাড়া চাচ্ছে।
এলিফ্যান্ট রোড এলাকার রাস্তা আইল্যান্ড পর্যন্ত ডুবে যায় রাতে। বন্ধ হয়ে যায় গাড়ি চলাচল। এক সংবাদকর্মী ফেসবুকে লিখেছেন, রাত সাড়ে ১০টায় সেগুনবাগিচা থেকে রওনা দিয়ে শ্যামলী পৌঁছলাম রাত ২টা ৪৫ মিনিটে।
রুপনগরের বাসিন্দা নাজমুস জানান, সিএনজি ভাড়া করে বাসায় ফেরার চেষ্টা করি। অল্প একটু যেতেই পানি ঢুকে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তিন থেকে চারগুণের বেশি চাওয়া হয়েছে রিকশাভাড়া। তার মতো এমন অভিযোগ অনেকেরই।
কাওরান বাজার থেকে এক সংবাদকর্মী ও ব্যবসায়ী জানালেন, সন্ধ্যা থেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম । শেষে বাধ্য হয়ে ভিজে বাসে উঠলাম। কিন্তু বাস আর চলছিল না। মিরপুর-২- এ পৌঁছলাম রাত সাড়ে ১২টারও পর। চারদিকে অথৈ পানি।
পান্থপথের এক দোকানী জানালেন, তার দোকানে পানি উঠে যায়। বললেন, বাসায় ফেরার গাড়ি পাচ্ছিলাম না। জলাবদ্ধতার কারণে অল্প দূরেই সেন্ট্রাল রোড পর্যন্ত যেতে রিকশা ভাড়া চাইলো আড়াইশ টাকা। উপায় নেই। হেঁটে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে নিতে হলো। পান্থপথ সিগন্যালের আশ-পাশের রেস্টুরেন্ট, মুদি দোকানের ভেতরেও পানি প্রবেশ করে।
সোহেল ইয়ামিন নামের একজন ফেসবুকে পোস্ট করেছেন- নিউমার্কেট থেকে কয়েক ঘণ্টায় কামরাঙ্গীরচর এসে দেখলাম সব গলি পানিতে একাকার। চেনাই মুশকিল । এর আগে তিনি নিউমার্কেটে প্রায় আড়াইঘণ্টা আটকে ছিলেন।
রাস্তায় জলাবদ্ধতায় অনেক যানবাহন বিকল হয়ে পড়ায় সেগুলোকে টেনে নিতে দেখা গেছে ধানমণ্ডি এলাকায়।
বেশ কিছু এলাকায় রাস্তায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ার খবরও পাওয়া গেছে। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডি ১৪ নম্বরের এক বাড়ির সামনে কড়ই গাছ ভেঙে পড়ে। এতে কেউ হতাহত হননি। তবে রাস্তায় তীব্র যানজট লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গাছটি এতই বড় যে, তা তাদের পক্ষে সরানো সম্ভব হয়নি। রাতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়, বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ছে, আবার আগুন লেগেছে—এমন খবর দিয়ে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা বাড়িতে পানি ঢুকে যায়। মোহম্মাদপুরের নবোদয় এলাকার কবির হোসেন নামের এক বাসিন্দা জানান, ভারি বৃষ্টিতে পানি ঘরের মধ্যে ঢুকেছে। আসবাবপত্র সব ভিজে গেছে। ঘরের মেঝেতে খাট পর্যন্ত পানি। এছাড়া ম্যানহলের ময়লা আবর্জনাও মিশেছে সে পানিতে।
ওদিকে, ঢাকায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। শুক্রবারও বৃষ্টি হতে পারে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর ঢাকা ছাড়াও রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে।