গাজা উপত্যকাকে যে ছলে বলে কলে কৌশলে দখল করে নেয়ার পাঁয়তারা হচ্ছে সে বিষয়েই ইঙ্গিত দিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। এ জন্যই তিনি গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধ হলেও শরণার্থীর যে ঢল তাদেরকে তার দেশে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, এসব শরণার্থীকে মিশরে প্রবেশ করতে দিলে একই দশা হবে পশ্চিমতীরের। সেখানকার মানুষকে একই কায়দায় জর্ডানে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড পড়ে থাকবে, এর মানুষ থাকবে না। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ড থেকে বের করে দিতে পারলে এই ভূমি হয়ে পড়বে অরক্ষিত।
বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, বুধবার মিশরের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি গাজার শরণার্থীর ঢল তার দেশে অনুমোদন করবেন না। কারণ, তাতে একই পরিণতি ঘটতে পারে পশ্চিমতীরে।
সফররত জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি কথা বলেন। এ সময় গাজা ও মিশরের মধ্যবর্তী রাফা ক্রসিংয়ে ইসরাইল বোমা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। বলেন, এ জন্য গাজা উপত্যকার প্রায় ২৪ লাখ মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকে মিশরে আশ্রয় দিলে একই পরিণতি হবে পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনিদের।
তাদেরকেও চলে যেতে হবে জর্ডানে। তার ফল হিসেবে আমরা যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র বিষয়ে কথা বলছি, বিশ্ব কথা বলছে, সেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ, তখন ভূমি পড়ে থাকবে। ভূমির মানুষগুলো থাকবেন না।
৭ই অক্টোবরে হামাসের রকেট হামলায় ইসরাইলে কমপক্ষে ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে।
তারপর গাজায় ভয়াবহ বোমা হামলা শুরু করেছে ইসরাইল। এর ১২তম দিনে জার্মান চ্যান্সেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় প্রেসিডেন্ট আবেদল ফাত্তাহ আল সিসির। অন্যদিকে গাজায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩৫০০। এর বেশির ভাগই বেসামরিক লোকজন। গাজা রয়েছে বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি ও খাদ্যের ভয়াবহ সঙ্কটে। কারণ, গাজার বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অবরোধ দিয়েছে ইসরাইল। সেখানে কিছু প্রবেশ করতে বা বের হতে পারবে না। এ অবস্থায় গাজার সঙ্গে রাফা ক্রসিং দিয়ে ত্রাণ পৌঁছানোর চাপ তীব্র আকার ধারণ করে। কারণ, ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে নেই এমন একটিমাত্র ক্রসিং এটি।
এর জবাবে প্রেসিডেন্ট সিসি বলেন, রাফা ক্রসিং মিশর বন্ধ করেনি। চারদিকের পরিস্থিতি এবং ক্রসিংয়ের বিপরীতপাশে ফিলিস্তিন অংশে বার বার বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এ কারণে ক্রসিংয়ের কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়নি। কয়েক শত লরি ত্রাণ ভর্তি করে এই ক্রসিংয়ে অপেক্ষা করছে ৬ দিন ধরে। এর মধ্যে গাজা অংশে চারবার বোমা হামলা করেছে ইসরাইল। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ওই সীমান্ত খুলে দিতে রাজি হয়েছে মিশর ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেখান দিয়ে ৬ ট্রাক করে ত্রাণ পৌঁছাতে পারবে গাজায়।
সাংবাদিকদের কাছে ওলাফ শুলজ বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার বিষয়ে এক সঙ্গে কাজ করছে বার্লিন ও কায়রো। বৈঠকে যুদ্ধ বন্ধে অবিলম্বে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আহ্বান করেন মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসি। তিনি বলেন, বিপজ্জনক এই সামরিক উত্তেজনা এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। জবাবে ওলাফ শুলজ বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ‘দাবানল’ এড়াতে চায় জার্মানি। হিজবুল্লাহ ও ইরানকে আবার এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ না করার সতর্কতা দেন তিনি। প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি বলেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতদের মিশরে আসা বন্ধে তিনি তার দেশবাসীকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাতে পারেন এবং তাদের মত প্রকাশ করতে বলতে পারেন। তাতে লাখ লাখ মিশরীয় রাস্তায় নেমে আসতে পারেন। উল্লেখ্য, মিশরে প্রায় এক দশক ধরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ নিষিদ্ধ। তার এ বক্তব্যের পর মিশরীয় মিডিয়া রিপোর্ট করেছে যে, হাজার হাজার মানুষ গাজার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে দেশজুড়ে বিক্ষোভ করেছেন।
ওদিকে কায়রোতে আল আজহার ইউনিভার্সিটি মঙ্গলবার একটি বিবৃতি ইস্যু করেছে। তাতে ফিলিস্তিনি ও নির্যাতিত মানুষের সমর্থনে সম্পদ ব্যয় করার জন্য মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। অহংকারী পশ্চিমাদের ওপর তাদের নির্ভরতা পর্যালোচনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে এতে।
আগের বছর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর ইসরাইলের সঙ্গে প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭৯ সালে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে মিশর। তবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জনমত থেকে যায় ব্যাপকভাবে। দুই দেশই নিরাপত্তা সহযোগিতা ও মসৃণ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। প্রেসিডেন্ট সিসি বলেন, ওই শান্তি এখন ঝুঁকিতে। যদি গাজা থেকে শরণার্থীদের ঢল মিশরের সিনাই অঞ্চলে শুরু হয়, তাহলে তা ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন এক অপারেশনের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। তিনি আরও বলেন, নিজের আত্মরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার অধিকার আছে ইসরাইলের। যদি নতুন ওই অপারেশন কেন্দ্র থেকে ইসরাইলে হামলা করা হয়, তাহলে মিশরের ভূমিতে সরাসরি হামলা করবে ইসরাইল।
গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের মিশরে আশ্রয় দেয়া হলে তাকে দ্বিতীয় নাকবা হবে বলে সতর্ক করেছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। নাকবা হলো ১৯৪৮ সালে কমপক্ষে ৭ লাখ ৬০ হাজার ফিলিস্তিনির দেশ ছেড়ে যাওয়া বা জোর করে দেশ থেকে বের করে দেয়া। এর ফলে ইসরাইল সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে।