বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। এটা তো কেতাবের কথা। বাংলাদেশে হয়। গেল অর্ধ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের বেশকিছু মডেলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আমরা। অভাবনীয় কিংবা অভূতপূর্ব কথাগুলোও এখানে পুরনো হয়ে গেছে। ভোট হয়েছে পাঁচ দিন হলো। সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। মন্ত্রিসভাও গঠন হয়ে গেছে। মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টনের কাজও শেষ। তবে বিরোধী দল কারা সে প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংসদ নেতা এবং স্পিকার মিলে বিরোধী দলের নেতা ঠিক করবেন।
ভোটের ফল সবারই জানা। আসলে প্রায় শতভাগ আসনেই শাসক দলের কোনো না কোনো ভাবে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। অফিসিয়াল ফল বলছে আওয়ামী লীগ ২২২টি, গেল দুটি সংসদের বিরোধী দলের আসন অলংকৃত করা জাতীয় পার্টি ১১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে জয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টি আবার যেসব আসনে জয়ী হয়েছে তার সবক’টিতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ ছিল। এবার বিরোধী দলের আসনে কারা বসবেন তা নিয়ে অবশ্য নির্বাচনের আগে থেকেই আলোচনা শুরু হয়। গত দুটি নির্বাচনেও বিরোধী দলের ভিন্ন ভিন্ন মডেল দেখা যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েও জয়ী হন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলটি নির্বাচনে থেকে যায়। পরে অবশ্য জাতীয় পার্টি একইসঙ্গে সরকারি দল এবং বিরোধী দলে যোগ দেয়। যেটা সে সময় অভিনব মনে হয়েছিল। গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও প্রাপ্য আসন অনুযায়ী জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সে সময় ‘সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি’, ‘রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি’ সংবাদ মাধ্যমে এমন বাক্যের ব্যবহার দেখা যায়।
বিরোধী দল খোঁজার এ জটিলতা অবশ্য বাংলাদেশে নতুন নয়। সংবিধান বা কোনো আইনে বিরোধী দল সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। সংবিধান প্রণেতারা তখন এ বিষয়ে কী চিন্তা করেছিলেন বলা মুশকিল। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ এমন কথা বলা আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল বা গ্রুপের নেতা।’ ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরও বিরোধী দল কারা হবে সে নিয়ে সংসদে প্রশ্ন উঠেছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জিতেছিল, অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্ররা সাতটি আসন পায়। ওই দলগুলো এবং স্বতন্ত্ররা আতাউর রহমান খানকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানান। ১৯৭৩ সালের ১৩ই এপ্রিল সংসদে এ নিয়ে বিতর্ক হয়। সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী দল বা গ্রুপের নেতাকে স্পিকার বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন বলে মত দিয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। বলেছিলেন, বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতির জন্য দল বা গ্রুপ ন্যূনতম কতোজন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে কার্যপ্রণালি বিধিতে তার কোনো উল্লেখ নেই। সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আতাউর রহমান খান একা এক দলের একজন, আরেক দলের একজন, আর কয়েকজন নির্দলীয় সদস্য মোট পাঁচ-সাতজন সদস্য সংসদ ভবনে একটি কক্ষে একটি জায়গায় বসতে চেয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর যুক্তি ছিল, ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো দলকে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায় না। তবে ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে কোনো দল গঠিত হলে এবং ওই দলে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য থাকলে ওই দলকে পার্লামেন্টারি গ্রুপ বলা যেতে পারে। কিন্তু সংসদীয় দল বলা যাবে না। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান দলগুলো বর্জন করেছিল। সে নির্বাচনের আগে আ স ম রবের নেতৃত্বে কয়েকটি দল নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল গঠিত হয়। নির্বাচনে তারা ১৯টি আসন পেয়ে বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এরইমধ্যে দলটির বিরোধী দল হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা জোট করে বিরোধী দল হয় কিনা এ নিয়েও আলোচনা রয়েছে। যদিও স্বতন্ত্র এমপিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা বা সংশ্লিষ্ট। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে, স্বতন্ত্র এমপিদের বিরোধী দল হতে বাধা নেই। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
তবে বিরোধী দল খোঁজার মতো বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক কিছুই বিশ্লেষণ করা দুরূহ। ভারতের খ্যাতিমান বিশ্লেষক, জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত যেমন ঢাকার একটি দৈনিককে বলেছেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিভ্রম ঘটেছে, আদৌ যদি এটাকে গণতন্ত্র বলা যায়। দুই বছর আগে লিখেছিলাম, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভঙ্গুর। সেই অবস্থা আরও খারাপ হলো। এখানে যেটা আমি দেখছি কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অধীনে যা যা হয়ে থাকে, তাই চলছে। অন্তত দু-তিন বছর ধরে তো বটেই।