কুষ্টিয়ায় ব্যবসায়ী মিলন হোসেন (২৭) হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ছয়জনকে আদালতে তুলে দুজনের সাতদিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। চার জনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। গ্রেফতার ৬ জনের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, হত্যার পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস কে সজিব নিজ হাতে মিলনের মরদেহ ৯ টুকরো করে।
রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে কুষ্টিয়া সদর আমলি আদালতে রিমান্ড আবেদন করার পর চার জনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জবানবন্দিতে আসামিরা কি জানিয়েছে তা জানা যায়নি।
শনিবার রাতে মিলনের মা শেফালি খাতুন বাদী হয়ে অজ্ঞাত বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করেন। আটক ছয়জনকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে আদালতে নেয়া হয়।
আদালতে নেয়া আসামিরা হলেন: কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়ার মৃত মিলন শেখের ছেলে সজীব শেখ (২৪), কুমারগাড়া এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে ফয়সাল আহমেদ (২৫), দেশওয়ালীপাড়ার কাজী ফরহাদ হোসেনের ছেলে কাজী লিংকন (৩২), সদর উপজেলার কান্তিনগর গ্রামের জনি প্রামাণিক (২১), হাউজিং সি ব্লকের আওলাদ খানের ছেলে ইফতি খান ও হাউজিং ডি ব্লকের সাইদুল ইসলামের ছেলে সজল ইসলাম (১৮)। সজীব জেলা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সহ-সভাপতি। এদের মধ্যে সজল ও ইফতির সাতদিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। সোমবার তাদের রিমান্ড শুনানি হবে। বাকি সজীব, ফয়সাল, লিংকন ও জনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হচ্ছে।
কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় মিলনের দাফনের পর তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য থানায় আসেন। নিহত মিলন হোসেনের মা শেফালি খাতুন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলা করার সময় মিলনের স্ত্রী মিমি খাতুন, দুলাভাই আশরাফুল ইসলামসহ গ্রামের আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
যেভাবে মিলনকে হত্যা করা হয়
থানায় জিডির পর থেকে লাশের টুকরো উদ্ধার ও জড়িতদের ধরার অভিযানে পুরো নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ। পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আরও ২/৩ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত জানা গেছে।
গ্রেফতার ৬ জনের বরাত দিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা জানান, বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে এগারটার দিকে ব্যবসায়ী অংশীদার সজল ফোন করে মিলনকে তাদের অফিসে (মিলনের) ডেকে নেয়। সেখানে আগে থেকে সজীবসহ আরও কয়েকজন অবস্থান নিয়েছিল। ওই কার্যালয়ে সজীব মিলনের কাছে চাঁদা দাবি করে। ভয়ভীতি দেখাতে তাকে মারধর করে। একপর্যায়ে মুখে গামছা গুজে নাক চেপে ধরে। ঘটনাচক্রে মিলন মারা যায়।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এসময় অফিসের দুটি কক্ষে সজীবদের অন্তত ১০ থেকে ১১ জন সদস্য ছিল। সেখানে দুটি কক্ষে তারা অবস্থান নেয়। লাশ গুম করতে সজীব পরিকল্পনার কথা জানায়। এসময় একজনকে সঙ্গে নিয়ে অফিসে তালা লাগিয়ে বাইরে চলে যায়। বাকিরা ঘরের ভেতর থাকে। দেড় ঘণ্টা ধরে শহরের তিনটি স্থানে দোকান থেকে কাটার যন্ত্র হেক্সো ব্লেড, পলিথিন ব্যাগ ও রক্ত পরিষ্কার করার জন্য জীবানুনাশক কেনে। তারা আবার বিকেল পাঁচটার দিকে অফিসে যায়। সেখানে গিয়ে দুর্বল চিত্তের ৪/৫ জনকে পাশের কক্ষে রাখে। সজীবসহ ৪/৫ জন মিলে এক কক্ষের বাথরুমে মরদেহ নিয়ে টুকরো করার কাজ করে। প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে কেটে ব্যাগে ভরে।
বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে চারটি মোটরসাইকেলযোগে সাতজন ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসে। বাকিদের সজীব যে যার মতো বাড়ি চলে যেতে বলে এবং বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকি দেয়। পুলিশ শহরের কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে তাতে দেখা গেছে রাত ৯টা ৩২ মিনিটের দিকে চারটি মোটরসাইকেলে সাতজন শহরের ছয় রাস্তা মোড় হয়ে হরিপুর সেতু নিয়ে পদ্মার চরের দিকে চলে যায়। রাত ১১টার মধ্যে লাশের টুকরোগুলো পদ্মার চরে বালু চাপা দিয়ে যে যার মতো বাড়ি চলে যায়। তবে সবাই স্বাভাবিকভাবে শহরে চলাফেরা করতে থাকে। কেউ পালানোর চেষ্টা করেনি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
যেভাবে জড়িতদের ধরা:
জিডির সূত্র ধরে সজলকে থানায় ডেকে নেয় পুলিশ। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কিন্তু বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সারাদিনেও সে কোন তথ্য জানায়নি। শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে সজল থানায় তার এক পরিচিত পুলিশ সদস্যকে মিলনকে হত্যার কথা জানায়। এরপর বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতে পারেন। শুক্রবার অভিযান চালিয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে সজীবসহ আরও চারজনকে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে থানায় নেয়। সজীব আটকের পর তার ফোনে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন নেতা ফোন করে। এসময় ফোনটি পুলিশের হেফাজতে ছিল। তবে আটকরা মিলনকে হত্যার কথা অস্বীকার করতে থাকে।
শুক্রবার রাতে সজীব কান্না করতে করতে একপর্যায়ে সব ঘটনা পুলিশকে জানায়। ভোরের দিকে লাশের টুকরা উদ্ধারে যায় অন্তত ৫০ সদস্যের পুলিশ টিম। মরদেহ গুমের পর লাশ টুকরো করতে ব্যবহৃত যন্ত্র বাধবাজার এলাকায় একটি পুকুরে ফেলে দেয় এবং মিলনের ব্যবহৃত মোবাইলফোনও জঙ্গলে ফেলে দেয়। সেই ফোন এখনও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ বলেন, ঘটনায় জড়িত থাকায় এখন পর্যন্ত ১৩/১৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। আরও অধিকতর যাচাই বাছাই চলছে। সব আসামিদের ধরা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা সবাই একে অপরের পরিচিত। মিলন হাউজিং এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতো। একই এলাকায় আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে অফিস হিসেবে অনলাইনে কাজ করতেন।
এদিকে জানা যায়, ইয়াসির আরাফাত তুষার ও সাদ আহাম্মেদের কমিটিতে ২০১৭-১৮ সালের দিকে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদকের পদ পায় এস কে সজিব। এরপর থেকেই কিশোর গ্যাং গঠন করে এলাকায় চাঁদাবাজি, মারধর, মাদক কারবারসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন তিনি।
নানা অপরাধে জড়িত হওয়ার পরও জেলা ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ পায় সজিব। এরপর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায় তাকে। তবে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজ চ্যালেঞ্জের ওপর হামলাসহ নানা অপকর্মের কারণে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।