মহিমান্বিত লাইলাতুল মেরাজ একটি পবিত্র রজনী। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত লাভের একাদশ বর্ষের রজব মাসের ২৭ তারিখ বরকতময় এ রাতে মহান আল্লাহর বিশেষ মেহমান হিসেবে আরশে আজিমে আরোহণ করেন। মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। পরিভাষায় মেরাজ হলো মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইলের (আ.) সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ ; মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসা। শবে মেরাজ বা লাইলাতুল মেরাজ এমন একটি রাত যে রাতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিবসের একটি মিরাজ। এই রাতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম নামাজের বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা মেরাজ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া অন্য কোনো নবী এই পরম সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। আর এ কারণেই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী।
নবুওয়াতের একাদশ বছর ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। যে বছর হযরত মুহাম্মদ (স.) কে এক সম্মানজনক রাত উপহার দেয়া হয়। যা নবীদের মধ্যে শুধুমাত্র মহানবী (স.)’র বিশেষ বৈশিষ্ট্য। একরাতে মহানবী (স.) হাতিমে কাবায় শুয়েছিলেন। বুখারী শরীফের এক বর্ণনানুযায়ী তিনি নিজ ঘরে শুয়েছিলেন। হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল (আ.) এসে বললেন আমাদের সাথে চলুন। বুরাক নামীয় স্পেশাল সওয়ারীর উপর আরোহণের মাধ্যমে পবিত্র এ শোভাযাত্রার সূচনা হয়। এই বুরাকের দ্রুতগামীতার অবস্থা এই ছিল যে যেখানে তার দৃষ্টিশক্তি পড়ছিল সেখানেই সে পা ফেলছিল। এভাবে বিরতিহীন যাত্রার পর প্রথমে তাকে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে আল্লাহতালা আগে থেকেই পূর্বেকার সকল আম্বিয়ায়ে কেরামকে সমবেত করে রাখেন তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়ার জন্য। এটা শুধুমাত্র বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.)’র একক বৈশিষ্ট্য।
মেরাজের একটা অংশ হলো ইসরা। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যেহেতু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ রাত্রিকালে হয়েছিল তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। বিশেষত বায়তুল্লাহ শরিফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফরকে ইসরা বলা হয়ে থাকে। কোরআনে আল্লাহতাআলা বলেন : তিনি পবিত্র (আল্লাহ) যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রিভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি। যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। বাইতুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে মহানবী (স.) তার বাহন সেই পাথরের সঙ্গে বাঁধেন যেখানে পূর্ববর্তী নবীরা তাদের বাহন বাঁধতেন। মসজিদুল আকসাতে তিনি তার পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তারপর তিনি সেসব নবীর ইমাম হয়ে দুই রাকাত সালাত বা নামাজ আদায় করেন। সেই নামাজে হজরত জিবরাইল (আ.) অংশ নেন।
নামাজ শেষ করে মহানবী (স.) হজরত জিবরাইলের সঙ্গে ঊর্ধলোকে গমন করেন। এই ভ্রমণে তিনি সাত আসমান শেষে মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন। প্রতিটি আসমানেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতারা মহানবীকে তাদের শুভেচ্ছা ও সালাম জানান। এ সময় তিনি প্রতিটি আসমানে পূর্ববর্তী নবীদের সাক্ষাৎ লাভ করেন।
প্রথম আসমানে : হযরত আদম (আ.)’র সাথে, দ্বিতীয় আসমানে : হযরত ঈসা (আ,)’র সাথে, তৃতীয় আসমানে : হযরত ইউসুফ (আ.)’র সাথে, চতুর্থ আসমানে : হযরত ইদ্রিস (আ.)’র সাথে, পঞ্চম আসমানে : হযরত হারুন (আ.)’র সাথে ষষ্ঠ আসমানে : হযরত মুসা (আ.)’র সাথে, সপ্তম আসমানে : হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র সাথে সাক্ষাত হয়।
অতঃপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহার দিকে সফর শুরু করেন। পথিমধ্যে হাউজে কাউসার অতিক্রম করেন। পরে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি খোদায়ি সব নিয়ামতের দর্শন লাভে সক্ষম হন। জান্নাতে থাকা স্পেশাল সব নেয়ামত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন। যা কোনো চোখ আজ পর্যন্ত দেখেনি কোনো কান শুনেনি এবং কোনো মানুষের কল্পনা শক্তিও সে পর্যন্ত পৌঁছেনি। এরপর তাঁর সামনে হাযির করা হয় জাহান্নাম। যা ছিল সর্বপ্রকার আযাব-গযবে ভরপুর। তাতে তিনি একদল লোককে দেখলেন যারা মৃত জন্তুর গোশত খাচ্ছে। প্রশ্ন করলেন এরা কারা। উত্তরে জিবরাঈল (আ.) বললেন এরা আপনার উম্মতের সেসব লোক যারা দুনিয়াতে নিজ ভাইদের গোশত খেত অর্থাৎ গীবত করত। এরপর দোযখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।
সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত হযরত জিবরাঈল (আ.) ছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী। এরপর হযরত নবীয়ে করীম (স.) এহান প্রভুও সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মাহবুবে খোদা সরদারে দুআলম আল্লাহতালার দর্শনে মনোনিবেশ করেন। এ দর্শন শুধু আন্তরিক ছিল না বরং চক্ষু দর্শনই ছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এবং সকল সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণের এ অনুসন্ধান। সেখানে মহানবী (স.) এহান সৃষ্টিকর্তার কুদরতি পায়ে সেজদায় পড়ে যান। মেরাজ রজনীর এ রাতে আল্লাহ তালা উম্মতে মুহাম্মদিকে স্পেশাল গিফট হিসেবে নামায দিয়েছেন। তাই নামাযকে বলা হয় মুমিনের মেরাজ। প্রভাতের আগেই কল্যাণময় এ সফরের সমাপ্তি ঘটে।
নামাজের হুকুম : আল্লাহর দিদারে আল্লাহতায়ালা উপহারস্বরূপ ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ (অবশ্য পালনীয়) হিসেবে পালন করার আদেশ করলেন। আমাদের নবী যখন এই আদেশ নিয়ে ফিরছিলেন তখন মুসা (আ.) জিজ্ঞাসা করলেন যে আল্লাহ তাকে কী দিয়েছেন। জবাবে আমাদের নবী (স.) ৫০ ওয়াক্ত নামাজের কথা বলেন। তখন তিনি আমাদের নবীর উম্মতের কথা বিবেচনা করে নামাজের পরিমাণ কমানোর সুপারিশ করার কথা বলেন। তখন আমাদের নবী পুনরায় আল্লাহর কাছে যান ও দরখাস্ত করেন। আল্লাহতায়ালা নামাজের পরিমাণ কমিয়ে ৪০ ওয়াক্ত করে দেন। এ আদেশ নিয়ে ফেরার সময় মুসা (আ.) পুনরায় জানতে চাইলেন। সব শুনে তিনি পুনরায় নামাজ কমানোর পরামর্শ দেন। এভাবে কয়েকবার সুপারিশ করার পর নামাজের পরিমাণ কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয় ও এর বিনিময়ে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব দানের প্রতিশ্রুতি দেন।
মেরাজের সত্যতা : আমাদের নবী যখন মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করেন তখন তা সব কুরাইশদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। বড় বড় কুরাইশ নেতারা তাকে অপদস্থ করার জন্য একত্রিত হতে লাগল। তারা এতটা উৎসাহিত ছিল যে বাইতুল মুকাদ্দাস যেতে মক্কা থেকে এক মাস সময় লাগে যা কিনা মহানবী (স.)-এক রাতে ভ্রমণ করে আবার ফিরে এসেছেন। তারা মহানবীকে (স.)-তার পক্ষে প্রমাণ দিতে বলেন। তখন মহানবী বাইতুল মুকাদ্দাসের বিস্তারিত বিবরণ দান করেন যা কি না একবারের যাত্রায় মনে রাখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তার ওপর মহানবী (স.) এর আগে কখনো যাননি। এ ছাড়াও তিনি একটি কাফেলার কথা বলেন যারা কিছুদিন পরই মক্কায় এসে পৌঁছায়। তিনি তাদের হারানো উট খুঁজে পেতে সাহায্য করেন। তার সব প্রমাণ শুনে কুরাইশরা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বিশেষ করে যখন ওই কাফেলা মক্কায় এসে তার সত্যতা নিশ্চিত করল। তার এই ঘটনা যখন প্রথমে কেউই বিশ্বাস করছিলেন না তখন হযরত আবু বকর (রা.) বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে এটা কি মহানবী (স.) নিজ মুখে বলেছেন কি না। তার এই বিশ্বাসের ফলে মহানবী (স.) তাকে সিদ্দিক (বিশ্বাসী) উপাধি দান করেন।
মেরাজের তাৎপর্য : ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তির একটি নামাজ বা সালাত। কালেমার পরই এর অবস্থান। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ ইবাদাত। মহানবী (স.) তার হাদিসে নামাজের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব হবে। তিনি আরও বলেন নামাজ বেহেস্তের চাবি। আর এই নামাজের হুকুম আল্লাহতায়ালা মিরাজের রাতে দিয়েছেন। এই বিবেচনায় মুসলিমদের জন্য লাইলাতুল মিরাজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ মেরাজ ছিল জাগ্রত অবস্থায় রূহ ও শরীরের উপস্থিতিতে। আর তা বাস্তবেই প্রমাণিত। সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি ও পবিত্র শবে মিরাজে তওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন-পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
পবিত্র লাইলাতুল মেরাজ : ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা
সংবাদটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন