ফেসবুকে চাকরির ফাঁদ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিদেশে চাকরির প্রলোভনের ফাঁদ পেতে নারী ও শিশু পাচার করে এমন একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাজধানীর হাজারিবাগ এলাকা থেকে দুই কিশোরী নিখোঁজের ঘটনার তদন্তে নেমে এই চক্রের সন্ধান পায় ডিবি।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার ভারতীয় সীমান্তের জিরোপয়েন্ট লাগোয়া গ্রাম কেরাগাছি এলাকার আব্দুল হামিদের দুই ছেলের নেতৃত্বে এই মানব পাচার চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে অল্প বয়সী নারী ও শিশুদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্ত দিয়ে পাচার করে আসছিলো। এই চক্রের মাস্টার মাইন্ড আনোয়ারুল। আর তার অন্যতম সহযোগী তার আপন বড়ভাই কবির হোসেন। আনোয়ারুল এলাকায় গরুর খামারের আড়ালে এই চক্র চালিয়ে আসছিল। আর কবির গাড়ি চালক বেশে চক্রের সংগ্রহ করা নারী ও শিশুদের পাচার করতো। এই চক্রটি অন্তত শতাধিক নারীকে পাচার করেছে বলে জানিয়েছে ডিবি।
পাচার হওয়া অন্যসব নারীদের মতো হারিয়ে যান খুলনা জেলার দৌলতপুর থানার কালিবাড়ি এলাকার জনি হাওলাদারের স্ত্রী সিমা আক্তার ও তার ১০ বছর বয়সী ছেলে নবাব শেখ। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন তারা। মা-ছেলেকে পাচার চক্রের সদস্যরা সীমান্ত এলাকায় নিয়ে গেলেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ ফজলে এলাহী ও তার টিমের দক্ষতায় বেঁচে যান তারা।
জানা গেছে, সিমাকে ফেলে স্বামী অন্যত্র চলে যাওয়ায় একমাত্র ছেলেকে নিয়ে শুরু করেন জীবন সংগ্রাম। তিনি একটি কারখানায় কাজ করতেন।
কাজ করে যা আয় হতো, তা দিয়ে জীবন বাঁচলেও ছেলে পড়াশোনা করাতে পারছিলেন না। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে পড়াশোনাসহ কোনো যোগ্যতা ছাড়াই ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় চাকরির একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান। যোগাযোগ করলেও জানানো হয়, পাশের দেশ ভারতে তাকে বাসা বাড়িতে কাজ দেয়া হবে। পাশাপাশি তার ছেলেকে পড়াশোনাও করানো হবে। এভাবেই আকর্ষণীয় বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলায় যেতে বলা হয়। আর এভাবেই চাকরির প্রলোভনে মানবপাচার চক্রের ফাঁদে পড়েন সিমা ও তার ১০ বছর বয়সী ছেলে নবাব শেখ।
উদ্ধার হওয়া সিমা আক্তার বলেন, আমার স্বামী অনেক আগে ছেড়ে চলে গেছেন। সন্তানেরও কোনো খোঁজ-খবর নেয় না। একটা ভমর তৈরির কারখানায় কাজ করে মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা পেতাম, এতে চলতে খুব কষ্ট হতো। হঠাৎ একটা চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করি। পরে ভারতীয় একটা নাম্বার থেকে আমাকে একজন ফোন দিয়ে জানতে চায় চাকরি করবো কি না। কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে সেই ব্যক্তি আমাকে বলে আপনাকে একটি বাসায় কাজ দেয়া হবে। আর আপনার ছেলেকে মাদরাসায় ভর্তি করে দিব। মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে। পরে আমাকে সাতক্ষীরা থেকে ফোন দিয়ে একজন যেতে বলে। আমি গেলে তারা আমাকে রিসিভি করে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে ডিবি আমাকে উদ্ধার করে এনেছে।
পাসপোর্ট, ভিসা ও কোনো ধরনের টাকা ছাড়াই পাচার চক্রের ফাঁদে পা দেয়া সিমা আরও বলেন, আমি ফোনে তাদের বলেছি আমি টাকা দিতে পারবো না। আমার পাসপোর্ট নেই। তখন তারা বলেছে, আমরা সব কিছুর ব্যবস্থা করবো। আপনি ভারত যাওয়ার পর চাকরি করে মাসে মাসে যা পারেন দিয়েন।
এই চক্রের বিষয় গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে সম্প্রতি দুই কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় একটি মামলা হয়। এই মামলা তদন্তে নেমে আমরা একটি মানব পাচার চক্রের সন্ধান পাই। যারা ফেসবুকে সহজে টাকা পয়সা ছাড়াই চাকরি দেয়ার নামে নারী ও শিশুদের পাচার করে আসছে। এমনকি এই চক্রের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে খুলনা থেকে এক নারী তার সন্তানকে নিয়ে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার সীমান্ত এলাকায় চলে গেছেন। চক্রের সদস্যরা তাকে পাচারের উদ্দেশ্যে নোম্যান্স ল্যান্ড এলাকায় নিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে তাদের উদ্ধার কার হয়। তবে যে মামলার তদন্তে নেমে এই চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে সেই দুই মেয়েকে আগেই তারা পাচার করে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চক্রের অন্যতম মূলহোতা সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার কেরাগাছি এলাকার আব্দুল হামিদের ছেলে কবির হোসেনকে। এরপরই বেরিয়ে আসে চাকরির বিজ্ঞাপনের আড়ালে মানব পাচার চক্রের রহস্য। দুই ভাই মিলে শতাধিক নারীকে পাচার করেছে বলে আমার জানতে পেরেছি।
অভিযানে অংশ নেয়া একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কবির ও আনোয়ারুলের বাড়ি বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের জিরো পয়েন্টে। স্থানীয় হওয়ায় নো ম্যানসল্যান্ড ল্যান্ডের সুবিধা কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নারী ও শিশু পাচার করে আসছিলেন। আনোয়ারুল গরুর খামার ও তার ভাই কবির অটোরিকশা চালানোর আড়ালে এই কাজ করছিলেন। প্রত্যেকটি নারী ও শিশুর জন্য তারা পেতেন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। তাদের এই সকল টাকার ভাগ পেতেন অনেকেই। যাদের বিষয়েও তথ্য পেয়েছেন কর্মকর্তারা। ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদে উঠেছে এসেছে এই সকল তথ্য। কবিরের বিরুদ্ধে তিনটি মানবপাচার মামলা রয়েছে।