১. অভিযোগ গুরুতর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টের এক সহকারী অধ্যাপিকা। অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগে কারো নাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু যেহেতু উনার নাম ইতিমধ্যে পত্রিকায় চলে এসেছে আমি তাই উল্লেখ করলাম। ০৯.০২.২৪ তারিখের প্রথম সারির কয়েকটি পত্রিকায় এবং টিভি চ্যানেলের অনলাইন ভার্সনে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগ পর্যন্ত আমি অধ্যাপক শহীদুল্লাহ অথবা মনোবিদ্যা ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপিকার কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করছি না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে অন্য জায়গায়।
২. ধরা যাক এই সহকারী অধ্যাপিকার নাম ডাক্তার মরিয়ম। উনি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যে মামলা করেছেন সেখানে উল্লেখ করেছেন যে অধ্যাপক শহীদুল্লাহ তাকে বেশ কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে শীলতাহানি/ধর্ষণ করেছেন। তাও সেই শ্রীলতাহানি হয়েছে ডাক্তার শহীদুল্লাহর অফিসে (হাসপাতালের ভেতরে)। অভিযুক্ত অধ্যাপক শহীদুল্লাহ সিনিয়র হওয়ায় চাকুরীর ভয়ে ডাক্তার মরিয়ম নাকি এতদিন কোনো অভিযোগ করেননি।
ডাক্তার শহীদুল্লাহ নিউরোলজির অধ্যাপক আর ডাক্তার মরিয়ম হলেন মনোবিদ্যা ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপিকা। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না নিউরোলজি থেকে মনোবিদ্যা বিভাগের সরকারি অধ্যাপিকার চাকরি কীভাবে ডাক্তার শহীদুল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করেন! উনার ভয়ে কেন আপনি এতদিন অভিযোগ করেননি? নাকি অন্য কোনো ঝামেলা আছে? শুনলাম উনার সাথে ২০ লক্ষ টাকা দিয়ে একটি হাসপাতালের প্রজেক্টে আপনি অংশীদার ছিলেন! আশা করি এই টাকা নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি!
৩. এবার অধ্যাপক শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। একই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপিকা নিজের শ্রীলতাহানি নিয়ে সহজেই মুখ খুলবেন না এটা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই বাস্তব। নিতান্তই বাধ্য হয়ে নিজের চরিত্রে কালিমা পড়েছে এমন অভিযোগ করছেন। আপনার রুমে উনি ঘন ঘন আসছিলেন কিনা এবং বিনা প্রয়োজনে আপনি ওনার সাথে সময় কাটাচ্ছিলেন কিনা তা বের করা খুবই স্বাভাবিক। আপনার অফিসের পিয়ন বা অন্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলেই এ রহস্য উন্মোচিত হবে। বারান্দার সিসিটিভি ফুটেজ তো আছেই। ডাক্তার মরিয়মের মামলার অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে আপনাকে একজন সাহসী ডাক্তার বলতেই হবে! নিউরোলজি বিভাগের অফিসটাকে বৃন্দাবন বানিয়ে ফেলেছেন!
৪. দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার সাংবাদিক শাহবাগ থানার উপ পরিদর্শক বজলুর রহমানকে এই অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি মামলা দায়েরের সত্যতা স্বীকার করেছেন। ফজলুর রহমান সাহেব আরো বলেছেন যে, অভিযুক্ত অধ্যাপককে গ্রেফতারের জন্য তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন। দেখা যাক উনাদের চেষ্টা কোথায় শেষ হয়!
৫. একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক ডাঃ হাবিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ওই সহকারী অধ্যাপিকা তাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেননি। তিনি শুনেছেন যে, শিগগিরই ঐ সহকারী অধ্যাপিকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করবেন। তিনি যদি অভিযোগ নাও করেন তাহলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
৬. এখানে একটি যুদ্ধ হচ্ছে। পেশী শক্তির যুদ্ধ! সে যুদ্ধের কিছু আলামত ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। একটি বহুল প্রচারিত টিভি চ্যানেলের অনলাইন ভার্সন থেকে খবরটি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। বাকি অনেকেই হয়তো খবরটি তুলে নেবেন। কেন নেবেন? এর পেছনে একটি রহস্য আছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো রহস্য নয়! খুবই সহজ! সবাই বুঝতে পারলেও কিছুই প্রকাশ করা হবে না!
৭. যেমনটা প্রকাশ করা হয়নি অধ্যাপক ডাক্তার আজিজ আহমেদ খান সাহেবের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট। উনি চর্ম রোগের অধ্যাপক হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান। দেশ টিভির ০৪.১২.২৩ তারিখের রিপোর্ট অনুসারে এই মহান অধ্যাপক এই মেডিকেল কলেজের ছাত্রী এবং মহিলা সহকর্মীদের ধর্ষণ করেই থেমে যাননি। সেই ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করেছেন। এবং সেই ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের বারবার ধর্ষণ করেছেন। দেশ টিভির ৫ মিনিটের রিপোর্ট দেখে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেছে। কারণ এ মেডিকেল কলেজের আমিও একজন প্রাক্তন ছাত্র। রিপোর্ট অনুসারে ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অভিযোগ দেয়ার পরেও তারা শীতনিদ্রায় ছিলেন। দেশ টিভির রিপোর্ট ভুক্তভোগী কয়েকজন নারী তাদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। যারাই এ রিপোর্ট দেখবেন তারা ভয়ে আঁতকে উঠবেন। অধ্যাপক সাহেব কি ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগে কুঞ্জবনের নতুন অফিস খুলেছেন নাকি?
৮. আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে মেডিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের দুই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে তা ফৌজদারী বা ক্রিমিনাল অফেন্স কিনা! তাহলে পুলিশ তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিনা! এ ধরনের ভয়াবহ অভিযোগ আসার পর এই দুই অধ্যাপককে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাসপেন্ড করা হয়েছে কিনা। অথবা হবে কিনা। BMDC (Bangladesh Medical and Dental Council) কি তাদের ব্যাপারে কোনো তদন্ত করবে? তাদের ডাক্তারি লাইসেন্স স্থগিত/ বাতিল করবে?
৯. এখানে দুই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রথম অপরাধ হচ্ছে professional misconduct যা তদন্ত করার দায়িত্ব পালন করবে BMDC. তাঁরা কিছু করবেন বা করতে পারবেন? দ্বিতীয় অপরাধ হচ্ছে ক্রিমিনাল অফেন্স। পুলিশ এর তদন্ত করবে। মামলা আদালতে যাবে। প্রয়োজনে জেল-জরিমানা হবে।
১০. চলে আসি অধ্যাপক শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ নিয়ে। পুলিশ বলছে তাকে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে যে গ্রেফতার করা হবে না তা আমি মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ এর আগেও এ ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ উত্থাপনের পরেও পুলিশ গ্রেফতার করেনি। প্রফেশনাল বডি থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
১১. কয়েক মাস আগে বারডেম হাসপাতালে পুলিশের দুই কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের এক কর্মকর্তার প্রেম ভালোবাসা এবং মারামারির কাহিনী নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। কারো বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়ার খবর আপনাদের কাছে আছে? শুনেছি বাইরে বদলি করা হয়েছে। এধরনের ভয়াবহ ঘটনার পর এ যদি হয় শাস্তি, তাহলে ধরে নিন অধ্যাপক শহীদুল্লাহ অথবা আজিজ আহমেদ খান সাহেবের কিছুই হবে না।
১২. অথবা কিছু হতেও পারে। আমি জানি না অধ্যাপক আজিজ আহমদ খানের ব্যাপারে বিভাগীয় বা পুলিশ তদন্ত রিপোর্টে কী আছে। উনি হয়তো নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। যদি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েই থাকেন তাহলে এ খবর কেন প্রচারিত হবে না?
১৩. ব্যক্তিগত জীবনে আপনি দুশ্চরিত্রের অধিকারী হতে পারেন। তবে আপনি যখন পাবলিক সেক্টরে দায়িত্ব পালন করবেন সেখানে আপনার ব্যক্তি চরিত্র অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। বিশেষ করে আপনি যদি ডাক্তারি পেশায় জড়িত থাকেন তাহলে আপনার ওপর মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থা অনেক বেশি থাকতে হবে।
১৪. উপরে যে দুটো অভিযোগের ব্যাপারে কথা বললাম সে অভিযোগ গুলো যদি ইংল্যান্ডে করা হতো তাহলে দুটো জিনিস ঘটতো। অভিযোগ পাবার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হতো। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো হতো। মোটামুটি নিশ্চিত যে পুলিশ এই দুই অধ্যাপককে গ্রেফতার করতো। কমপক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডেকে পাঠাতো। অভিযোগ চূড়ান্ত হলে (চার্জশিট) বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দুই ডাক্তার দায়িত্বে ফিরতে পারতেন না। তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ থাকতো। রেগুলেটরি বডি (GMC) তাদের লাইসেন্স সাসপেন্ড করতো। চূড়ান্ত শুনানির আগ পর্যন্ত ( কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর) তাদের ডাক্তারি লাইসেন্স স্থগিত থাকতো। Professional Misconduct প্রমাণিত হলে এই দুই অধ্যাপক আজীবনের জন্য ডাক্তারি পেশায় নিষিদ্ধ হতেন।
১৫. General Medical Council (GMC) এর আদলে বাংলাদেশে বিএমডিসি আছে, পুলিশ এবং আদালতও আছে। কিন্তু তারা জীবিত আছেন, মারা গেছেন না গভীর শীতনিদ্রায় আছেন তা উপলব্ধির উপায় নেই। শীতনিদ্রা না বলে আমি বলবো গভীর নিদ্রা। এ থেকে জেগে ওঠার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। তাই যারা জেগে আছেন তাঁরা পরবর্তী বৃন্দাবন/কুঞ্জবনের কাহিনী শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকুন।