পবিত্র জিলহজ মাস মানে হজের মাস। হজের তিনটি মাস শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান মাস হলো জিলহজ মাস। এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কোরআন কারিমে আল্লাহতাআলা বলেন হজ সম্পাদন সুবিদিত মাসসমূহে। অত:পর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রীসম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহবিবাদ বিধেয় নহে। তোমরা উত্তম কাজে যা কিছু করো আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা করবে আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ তোমরা আমাকে ভয় করো (সুরা-২ বাকারা, আয়াত : ১৯৭)। বছরের বারো মাসের চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। এই চার মাসের অন্যতম হলো জিলহজ মাস। চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এই চার মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ কলহবিবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশেষ কিছু দিন এবং রাত এমন রয়েছে যেসব দিন ও রাতের ইবাদত-বন্দেগিতে মহান আল্লাহতাআলা অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করেন। তন্মধ্যে কদরের রাত, বরাতের রাত, দুই ঈদের রাত, রমজানের আমল, আশুরার আমল, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমল ইত্যাদি। এ দিনগুলোর আমল-ইবাদত ইখলাসের সঙ্গে করলে আল্লাহতাআলা বান্দার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। এসব দিন ও রাতে বান্দার তাওবায় আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে যায়।
সৃষ্টিকর্তা দয়াময় আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের মধ্যে আরবি জিলহজ মাসের প্রথম দশক আগমন করতে যাচ্ছে। আল্লাহতায়ালা আমাদের দিনগুলোকে বরকতময় করুন এবং সৎকর্মে পরিপূর্ণ করুন। নিশ্চয় এ মৌসুমটি কল্যাণকর বিষয়ে প্রতিযোগিতা, সৎকাজের পাথেয় সংগ্রহ এবং ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের প্রভুর সান্নিধ্য অর্জন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন শপথ ফজরের শপথ দশ রাতের। {সুরা আল ফাজর : ১-২} পবিত্র জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দিনে রোজা পালন করা, রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত। যথা : নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ, তওবা- ইস্তিগফার ইত্যাদি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়। প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো। হিজরি সালের সর্বশেষ মাস জিলহজ। মহান আল্লাহ এই মাসকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহর ঘরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মুসলিমরা এসে জড়ো হন। এই মাসের প্রথম ১০ দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন এই দিনগুলোর (অর্থাৎ জিলহজের প্রথম ১০ দিনের) তুলনায় এমন কোনো দিন নেই যাতে কোনো সৎকাজ আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। লোকেরা বলল আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি ? তিনি বললেন আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে কোনো (মুজাহিদ) ব্যক্তি যদি তার জান-মালসহ বের হয়ে যায় এবং তার কোনো কিছুই নিয়ে আর ফিরে না আসে। (অর্থাৎ-শাহাদতবরণ করে তাহলে হয়তো তার সমান হতে পারে)। হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে সাহাবাগণ বললেন হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এ কোরবানি কী ? উত্তরে তিনি বললেন তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.) এর সুন্নত। তাঁরা পুনরায় বললেন হে আল্লাহর রাসুল! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে ? উত্তরে তিনি বললেন কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে। তাঁরা আবারও প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ভেড়ার লোমের কী হুকুম ? (এটা তো গণনা করা সম্ভব নয়) তিনি বললেন ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।
পবিত্র জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্র্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষেরা স্বাভাবিক স্বরে আর মহিলারা নিচু স্বরে এ তকবির বলবেন। তকবির হলো : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ। দুনিয়ার সেরা আত্মত্যাগের মাস জিলহজ। এ মাসেই হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কোরবানির মাধ্যমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর এ ধারা মুসলিম উম্মাহ কেয়ামত পর্র্যন্ত অব্যাহত রাখবেন। এ কারণেই আমল ও ফজিলতে মর্যাদাসম্পন্ন মাস জিলহজ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন জিলহজ মাসের প্রথম দশকের নেক আমল আল্লাহর নিকট যত বেশি প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর নিকট তত প্রিয় নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যার কোরবানির পশু রয়েছে বা যার পক্ষ দিয়ে কোরবানি করা হবে সে যেন জিলহজ মাসের নতুন চাঁদ ওঠার পর থেকে কোরবানি করার আগ পর্যন্ত চুল ও নখ না কাটে। যারা কোরবানি দিবেন না তারাও এ আমলটি করলে কোরবানির সওয়ার পাবেন।
পবিত্র জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমল আল্লাহর কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল যে মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেককেই বেশি বেশি নেক আমল করা উচিত। আল্লাহর দেওয়া বিধানগুলো যথাযথ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নাত, নফল, মোস্তাহাব ও নফল নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, দান-অনুদান, সাহায্য সহায়তা বেশি বেশি করা জরুরি। যাতে সে সময় গুলোতে বান্দা বেশি বেশি ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পাওে ; নিজেদের পাপ ও গুনাহ মাফ করিয়া নিতে পারে। এমনই এক বিশেষ সময় হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। এই দিনগুলোকে রাসুল (সা.) বছরের শ্রেষ্ঠ দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। পবিত্র হজ ও কোরবানির মাস জিলহজ। এটি হিজরি বছরের শেষ মাস। এই হিজরি মাসের ৯ তারিখ সারাবিশ্ব থেকে আগত মুসলিম উম্মাহ আরাফায় একত্রিত হবেন। পরদিন বিশ্বব্যাপী সবাই কোরবানি করবেন। ঈদের নামাজের পর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করবে মুসলিম উম্মাহ। জিলহজ মাসের প্রথম দশকের রয়েছে বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ আমল। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ যে কোনো দিন কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। পুরুষ ও নারীর সবার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য। তাই এ মাসের প্রথম দশকের আমল বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় আল্লাহ তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় ও ফজিলতপূর্ণ। এক হাদিসে রাসূল সা. এই ১০ দিনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে জিহাদের চেয়েও এ দিনগুলোর আমলকে ফজিলতপূর্ণ বলেছেন।
চান্দ্রমাসসমূহের বিভিন্ন সময়ের ফজিলত রয়েছে। তন্মধ্যে রমজানের শেষ দশক ও জিলহজ মাসের প্রথম দশক উল্লেখযোগ্য। জিলহজের শেষ দশকের মধ্যে নবম দিবস আরাফার দিনে নফল রোজা রাখা দশম দিবসে কুরবানি করা উত্তম। হজের ক্ষেত্রেও আরাফাতের পরের দিন দশম দিবসে হজযাত্রীর কষ্টসাধ্য আমল রয়েছে। যথা : রমি করা দমে শুকরিয়া তথা হজের কুরবানি করা। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে এ দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। কাজেই তোমরা এ সময় বেশি বেশি তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ পাঠ করো। হে আল্লাহ! জীবিত ও মৃত মুসলিমদের আপনি ক্ষমা করুন। আমাদের আপনার সন্তোষজনক আমল করার তাওফিক দান করুন আপনার ক্রোধ ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে দূরে রাখুন। মুসলিমরা পৃথিবীর যে যেখানে রয়েছে তাদের আপনি হেফাজত করুন মুসলিমদের দুশ্চিন্তা দূর করুন দুর্দশাগ্রস্তদের দুর্দশা দূর করুন এবং তাদের আপনার বিশেষ তত্ত্বাবধানে হেফাজত করুন। আল্লাহ যেন আমাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও তার ঘর জিয়ারত করার তৌফিক দান করেন এবং সবাইকে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে যথাসময়ে হজ পালন করার তৌফিক দান করেন। আমিন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
পবিত্র জিলহজ মাসের ফজিলত ও আমল
সংবাদটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন