সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরে পানি
সাওরাত হোসেন সোহেল, চিলমারী (কুড়িগ্রাম) থেকে: পানি যেভাবে বাড়ছে বাহে কল্পনা করি নাই। রাতে খাইয়া-দায়া ঘুমাইলাম আর সকালে উঠে দেখি ঘরত পানি। কাবধাপ (তাড়াতাড়ি) করে ঘরের জিনিসপত্র পাশের বাঁধের রাস্তায় তুলতেছি। খুব বিপদে পড়ছি হঠাৎ করি পানি আসায়। কথাগুলো বললেন উপজেলা জোড়গাছ পুরাতন বাজার বাঁধ এলাকার নূরবানু, জোবেদাসহ বেশ কয়েকজন। ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই সঙ্গে উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দি মানুষের মাঝে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। তবে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো করছে মানবেতর জীবন-যাপন। জানা গেছে- বাড়ছে পানি, তলিয়ে যাচ্ছে গ্রাম।
ভাঙছে বসতবাড়ি, নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দি মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থান, বাঁধে আশ্রয় নেয়া শুরু করেছে।
সরজমিন, উপজেলার জোড়গাছ বাঁধ, মাস্টারপাড়া, টোনগ্রাম, হরিণেরবন গ্রাম, চরউদনা, সরকারপাড়া, থানাহাট ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ সময় জোড়গাছ বাঁধ এলাকার নূরবানু, জোবেদা, লালমিয়া বলেন, শুক্রবার রাতে খাওয়া-দাওয়া করি শুইলাম ভালো আর সকালে উঠে দেখি সারাবাড়ি পানি, ঘরের ভিতর পানি, হঠাৎ এতো দ্রুত পানি উঠবে ভাবতে পারি নাই। শুধু নূরবানু, জোবেদা নন, জোড়গাছ পুরাতন বাজার থেকে রাজারভিটা পর্যন্ত ওয়াবদা বাঁধে আশ্রয় নেয়া শুরু করেছে পানিবন্দি পরিবারগুলো। সদ্য ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধে আশ্রয় নেয়া মানুষজন পড়েছে বিপাকে। এদিকে উপজেলা চিলমারী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষজন। থানাহাট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক মিলন বলেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তার ইউনিয়নের প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভাঙনের তীব্রতা রয়েছে স্বীকার করে চিলমারী ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ কষ্টে আছে। ইতিমধ্যে বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে প্রশাসন। শনিবার সকালে উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নে ১নং ওয়ার্ডের বন্যার্ত শতাধিক পরিবারের মাঝে চাল বিতরণ করেছেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ। এ সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাহবুবুর রহমানসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পানিবন্দি ৪০ হাজার মানুষ
নীলফামারী, ডোমার ও ডিমলা প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা অব্যাহত পাহাড়ি ঢল আর কয়েকদিনের টানাবর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মিনিটে সাড়ে ৪ লাখ কিউসেক পানি ঢুকছে তিস্তায়। এতে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফসলি জমি, গবাদিপশুসহ ঘরবাড়ির দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে পানিবন্দি পরিবারগুলো। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে কাজ করছেন স্থানীয় প্রশাসন। গতকাল সকাল ৬টায় দেশের বৃহত্তম সেচপ্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহের উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ মিটার ৩৫ সেন্টিমিটার। পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত শুক্রবার সকাল ৬টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যা এবারের মধ্যে সর্বোচ্চ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাফ উদ দৌলা বলেন, টানা বৃষ্টিপাতে ভারতের গজলডোবায় তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় উজানের ঢলে ডালিয়া পয়েন্টে পানি বেড়েছে। এ পয়েন্টে তিস্তার পানি টানা ৪৮ ঘণ্টা ধরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে উজানের ঢলের পানি প্রতি মিনিটে সাড়ে চার লাখ কিউসেক করে ভাটির দিকে আসছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মানুষকে সচেতন করছি। আমাদের লোকজন বাঁধগুলোতে টহল দিচ্ছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড তা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে। এদিকে পানিপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ৫ জেলার নদী তীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার কয়েক হাজার পরিবার। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে সদ্য রোপণ করা আমন ধানের ক্ষেত। পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিস্তার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বছর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো নামমাত্র সংস্কার করলেও বর্ষায় বৃষ্টির পানিতে অধিকাংশ স্থানে ধসে যাচ্ছে। ফলে নদীতে পানির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে এলাকাবাসী আতঙ্কে রয়েছে। ডিমলার চর কিসমত এলাকার শাহিনুর বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে বাড়িতে পানি উঠতে শুরু করেছে। এখন ঘরের ভেতরে হাঁটুপানি। পোকামাকড়ের ভয়ে ঘুম আসে না, বিছানায় নির্ঘুম কাটাতে হচ্ছে। একই গ্রামের আশরাফুল বলেন, চারপাশে শুধু পানি আর পানি। সব ডুবে যাচ্ছে। ঘরে মাচা বানিয়ে সেখানে একবেলা রান্না করে তিন বেলা খেতে হচ্ছে। বাচ্চাদের নিয়ে আতঙ্কে থাকি। ডিমলা উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মেজবাহুর রহমান বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ২০ মেট্রিক টন চাল ও দুই লাখ টাকা মজুত রয়েছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক পর্যেবক্ষণ করছি। স্থানীয় ইউপি’র চেয়ারম্যানদের পানিবন্দি মানুষের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। তালিকার পর জানা যাবে, কী পরিমাণ মানুষ পানিবন্দি। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত আছে। প্রয়োজনে আমরা ত্রাণসহায়তা শুরু করবো।
যমুনায় ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ২৮ সেন্টিমিটার
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত কয়েকদিন ধরে উজানে ভারী বর্ষণের ফলে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ ও কাজিপুর পয়েন্টে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ করতোয়া, ফুলজোড় ও বড়াল নদীর পানিও। শনিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৬১ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ২৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা: ১২ দশমিক ৯০ মিটার)। অপরদিকে, কাজিপুরের মেঘাই ঘাট পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১৯ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ২২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৬১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা ১৪.৮০ মিটার)। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রণজিত কুমার সরকার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এদিকে দ্রুতগতিতে পানি বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরের চরাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।
তলিয়ে যেতে শুরু করেছে বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল। ফলে জেলার কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলায় বন্যা আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন নদীতীরবর্তী এলাকার মানুষ। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, উজানে ভারী বর্ষণে যমুনা নদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। পানি আরও ৩/৪ দিন বাড়বে। এতে সিরাজগঞ্জ ও কাজিপুর পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রমের সম্ভাবনাও রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যেই ৬৫০ টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। এর মধ্যে শাহজাদপুর উপজেলার ভাঙন কবলিত এলাকায় ১০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আমরা তালিকা করছি। তালিকা অনুযায়ী সেগুলো বিতরণ করা হবে।


