ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। ১১তম দিনে এসেও দিনভর বিমান হামলা চলছে গাজায়। অবরুদ্ধ অঞ্চলটির উত্তর দিক থেকে অধিবাসীদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। অথচ তারা সেখানে সরে যাওয়ার পর পর গাজার সেই দক্ষিণাঞ্চলে রাফাহ শহরে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে কমপক্ষে ৭১ জন নিহত হয়েছেন বলে খবর দিয়েছে ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা। হামলা চালাচ্ছে গাজার উত্তরাঞ্চলেও। গাজায় স্থল হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখলেও তা শুরু করেনি ইসরাইল। এ অবস্থায় বুধবার ইসরাইল সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জোর দিয়ে বলেছেন, হামাসের হামলা থেকে আত্মরক্ষার অধিকার আছে ইসরাইলের। সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরাইলের হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৮০০ মানুষ।
এর বেশির ভাগই বেসামরিক। ওদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদুল্লাহিয়ান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলেছেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে আগে থেকেই কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারে ইরানপন্থি গ্রুপগুলো। এমনকি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা হতে পারে। হামাসের কাসেম ব্রিগেড বলেছে, এখন গাজায় তাদের হাতে আটক আছে ২৫০ ইসরাইলি। যদি পরিস্থিতি অনুমোদন করে তাহলে তারা এসব বন্দিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত। ইসরাইলের অবরোধের ফলে গাজা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেখানে ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে পানি, খাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও ওষুধপত্র। ফলে অবরুদ্ধ এসব মানুষ এসবের অভাবে এমনিতেই মারা যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইসরাইল যখন গাজা উপত্যকায় এ অবস্থার মধ্যে বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে, তখন এ সতর্কতা উচ্চারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত রিপোর্ট ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে একই অবস্থানে আসতে আলোচনায় বসার কথা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের। এর একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, আমাদেরকে একটি অবস্থানে আসা প্রয়োজন। এ অবস্থায় স্থানীয় সময় সোমবার বিকাল সাড়ে তিনটায় নেতাদের একটি ভিডিও কনফারেন্স হওয়ার কথা। এতে সভাপতিত্ব করার কথা ইউরোপিয়ান কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেলের।
এদিকে সোমবার ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটের অধিবেশন ভেস্তে যায় হামাসের রকেট হামলায়। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বক্তব্য শেষ করতেই ইসরাইলে রকেট হামলা চালায় হামাস। ফলে দ্রুততার সঙ্গে পার্লামেন্ট সদস্যরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। অচল হয়ে যায় অধিবেশন। ৪০ মিনিট বিলম্বে আবার অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হয়। এমন এক অধিবেশনে ইরান ও লেবাননের যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে হুঁশিয়ারি দিলেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, আমাদের পিছু নেয়ার চেষ্টা করো না। করলে, মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। যখন হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা, তখন সোমবার ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটের উদ্বোধনী অধিবেশনে এমন কড়া হুঁশিয়ারি দেন নেতানিয়াহু। এতে তিনি ইরান ও হিজবুল্লাহকে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। ওদিকে হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল করতে গাজা উপত্যকায় বড় আকারে স্থল সামরিক অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)।
ওই ভাষণে নেতানিয়াহু হামাসকে পরাজিত করতে বিশ্ববাসীকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ৭ই অক্টোবর ভয়াবহভাবে অনুপ্রবেশ করে হামাস। তার দেশের এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়া শুরু করেছে ইসরাইল। এ ঘটনা তদন্ত করে দেখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। তার এ মন্তব্য করার পর পরই জেরুজালেম ও অন্য এলাকায় গাজা উপত্যকা থেকে রকেট হামলা চালানো হয়। ফলে নেসেটের সদস্যদেরকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যেতে হয়। এ কারণে নেসেটের অধিবেশনের কর্মকাণ্ড ৪০ মিনিট বিলম্বিত হয়। পরে প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ ও বিরোধীদলীয় নেতা ইয়াইর লাপিদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো হামাসের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন। তাদের শাসনকে উৎখাত করা।
উল্লেখ্য, হামাসের হামলার পর ইসরাইল তার তিন লাখ রিজার্ভ সেনাকে তলব করেছে। তার সঙ্গে রয়েছে দেড় লাখ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার পর্যন্ত সেনাসদস্য। তাদের বড় অংশকে গাজা সীমান্তে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় তারা গাজার ভেতরে ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করতে পারে। ওদিকে এই যুদ্ধের কারণে দেশজুড়ে মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচন বিলম্ব করছে নেসেট। এই নির্বাচন ৩১শে অক্টোবর হওয়ার শিডিউল ছিল। এই নির্বাচন বিলম্বিত করে আগামী ৩০শে জানুয়ারি করার একটি বিল তোলা হয়েছে পার্লামেন্টে।
ইসরাইলি হুমকির জবাবে গাজায় ইসরাইলের স্থল হামলা প্রস্তুতির জবাবে হামাস বলেছে- আমাদের ভয় দেখাবেন না। আমরা প্রস্তুত। হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র আবু ওবেইদে সোমবার এ মন্তব্য করেছেন। টেলিভিশনে প্রচারিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ৭ই অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক হামলার পর ইজ্জেদিন আল কাসেম ব্রিগেডের হাতে এখনো ২০০ ইসরাইলিকে জিম্মি রাখা হয়েছে। অন্য প্রায় ৫০ জনকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অন্য সংগঠনগুলো অন্য জায়গায় আটকে রেখেছে। তিনি বলেন, দখলদাররা আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে স্থল অভিযান চালানোর হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু আমরা তাতে ভীত নই। আমরা এর জন্য প্রস্তুত আছি।
ইসরাইলের সামরিক মুখপাত্র ডানিয়েল হাগারি সোমবার বলেন, হামাসের হাতে জিম্মি ১৯৯ জন ব্যক্তির আত্মীয়দের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তারা। ওদিকে হামাস মুখপাত্র আবু ওবেইদে বলেন, আমাদের শর্ত যখন পূরণ হবে, তখনই বিদেশি এসব বন্দিকে মুক্তি দেবো। তিনি আরও বলেন, ইসরাইল থেকে জিম্মি হিসেবে আটক করা কমপক্ষে ২২ জনকে ইসরাইলই গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে।
এদিকে আয়োজকরা ইসরাইলপন্থি অবস্থান নেয়ার প্রতিবাদে ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে মালয়েশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ফিলিস্তিনে যে সহিংসতা চালাচ্ছে ইসরাইল তার সঙ্গে আপস করবে না মন্ত্রণালয়। ইসরাইলের এই সহিংসতা আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মালয়েশিয়া সরকার সবসময়ই ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি ও পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করে। এই ধারা অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রতি বছরের মতো জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বইমেলা শুরু হয়েছে। একই কারণে এই মেলা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক প্রকাশনা সংস্থা নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। এর মধ্যে আছে আরব পাবলিশার্স এসোসিয়েশন, দ্য এমিরেটস পাবলিশার্স এসোসিয়েশন, শারজাহ বুক অথরিটি অ্যান্ড পাবলিশার্স। ইসরাইলে হামাসের হামলা চালানোর কারণে ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী লেখক আদানিয়া শিবলিকে সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠান স্থগিত করে বইমেলার আয়োজকরা। এর ফলে বইমেলা থেকে ওইসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।


