আরবি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সনের পঞ্চম মাস হলো জমাদিউল আউয়াল। এর জোড়া মাস হলো জমাদিউস সানি-এটি হিজরি আরবি সনের ষষ্ঠ মাস। আরবিতে এই মাস দুটির নাম হলো-প্রথমটি আল জুমাদাল ঊলা, দ্বিতীয়টি আল জুমাদাল উখরা বা আল জুমাদাল আখিরাহ অথবা আল জুমাদাস সানিয়াহ। সহজ করে বললে প্রথমটি জুমাদাল ঊলা দ্বিতীয়টি জুমাদাল উখরা বা জুমাদাল আখিরা অথবা জুমাদাস সানিয়াহ। ইমাম ফাররা (রহ.)-বলেন আরবি মাসের নামগুলো পুরুষবাচক তবে জুমাদা এ দুই মাস নয় কারণ এ দুটি স্ত্রীবাচক। তিনি আরও বলেন জুমাদা শব্দের পুরুষবাচক প্রয়োগ দেখলে বুঝতে হবে এটি শাহার শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এই মাস দুটি জমাদিউল আউয়াল ও জমাদিউস সানি নামে সমধিক পরিচিত। এর বাংলা অর্থ হলো প্রথম জুমাদা ও দ্বিতীয় জুমাদা বা প্রথম শীত ও দ্বিতীয় শীত অর্থাৎ, শীতকালের প্রথম মাস ও শীতকালের দ্বিতীয় মাস। আরবের শীতকাল জমাদিউল আউয়াল।
আরবি বর্ষপঞ্জির বারোটি মাসের মধ্যে ছয়টি মাসের নামের শেষে অতিরিক্ত বিশেষ কোনো বিশেষণ যুক্ত হয়নি। সেই মাসগুলোর প্রথম চারটি হলো : তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ মাস তথা রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল ও জমাদিউস সানি। অন্য দুই মাস হলো হিজরি সনের একাদশ ও দ্বাদশ মাস তথা জিলকদ ও জিলহজ। বছরের অন্য ছয়টি মাসের নামের শেষে বিশেষ কোনো না কোনো বিশেষণ যুক্ত রয়েছে। এ মাসগুলো হলো প্রথম ও দ্বিতীয় মাস ; সপ্তম, অষ্টম এবং নবম ও দশম মাস। যথা আল মুহাররামুল হারাম (নিষিদ্ধ মহরম মাস) আস সফরুল মুসাফফার (বর্ণিল সফর মাস) ; আর রজবুল মুরাজ্জাব (মহিমান্বিত রজব মাস) আশ শাবান নুল মুআজ্জম (মহান শাবান মাস), আর রমজানুল মোবারক (বরকতময় রমজান মাস) আশ শাউওয়ালুল মুকাররাম (সম্মানিত শাওয়াল মাস)। লক্ষণীয় যে বর্ষের প্রথমার্ধের শেষ চার মাসে ও দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দুই মাসে এবং প্রথমার্ধের প্রথম দুই মাস ও দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম চার মাসে একই বিষয় সংঘটিত হলো।
জুমাদা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো স্থির, অবিচল, দৃঢ়, কঠিন ; জমাটবদ্ধ, নিস্তব্ধ, নীরব, নিথর, শুষ্ক, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত ; শীতল, শীতকাল, শীতবস্ত্র ; কার্পণ্য, বদ্ধমুষ্টি ; কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অস্থির সময়, চিন্তাযুক্ত অবস্থা। যেহেতু আরব দেশে শীতকালে প্রচন্ড শীতে তরল পানি জমে কঠিন বরফে পরিণত হতো ; জড় পদার্থগুলো জমে শক্ত হয়ে যেত ; উদ্ভিদ ও জীব নিথর হয়ে থাকত ; প্রাণীরা নীরব হয়ে যেত ; তাই এই মাসের এ নামকরণ করা হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-বলেন জুমাদা হলো আরবদের শীতকাল। এটি বসন্তের নিকটবর্তী ; গ্রীষ্মের পূর্বে। কারণ দুই ভূমির সীমানা বা দুই বাড়ির সীমানাকে এবং নিকট প্রতিবেশীকেও জুমাদা বলা হয়। একত্রে এ দুই মাসকে জুমাদায়ান বা জুমাদায়িন বলা হয়।
মূলত জমাদিউল আউয়াল মাসের নামের মাঝে যেসব অর্থ বিদ্যমান তা তিন ভাগে বিভাজনযোগ্য। যথা ইতিবাচক অর্থ, নেতিবাচক অর্থ ও মধ্যবর্তী বা ক্রান্তিকালীন অর্থ। সুতরাং আমাদের করণীয় হবে ইতিবাচক অর্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও বেশি বেশি নেক কাজ বা সত্কর্ম সম্পাদনে ব্রতী হওয়া। নেতিবাচক অর্থগুলো অনুধাবন করে নিজের মধ্যে থাকা সব নেতিবাচক অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করে ইতিবাচক কর্মকান্ডের প্রতি মনোনিবেশ করা। ক্রান্তিকাল বা অন্তর্র্বতীকালীন বিবেচনা করে সদা সতর্ক ও সজাগ থাকা এবং ইতিবাচক পরিবর্তন ও সাফল্য লাভের জন্য সব সময় সক্রিয় থাকা। যেসব দিবসের ও যেসব মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সে সব দিনে ও মাসে সবাই ইবাদত করবেন এবং করেও থাকেন-এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং যেসব দিন ও মাসের বিশেষ ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি সে সব দিন ও মাসে বেশি করে নেক আমল করলে আমলকারী অবশ্যই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবেন ও অগ্রগামী হবেন। পরকালে নেককার মুমিন জান্নাতিদের কোন আফসোস থাকবে না। আফসোস হবে যারা বেহুদা সময় কাটাবেন তাদের এই সময়ের জন্য। যে সময় গুলো তারা অবহেলায় পার করেছেন কোন আমল করা ছাড়া।
জমাদিউল আউয়াল মাসের ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন কিতাবে নানা বিষয় বর্ণিত আছে। আসল কথা হলো হার কে কদরে শব দারাদ ; হামা শব শবে কদর আস্ত অর্থাৎ যেজন রাতের মূল্য দেন ; প্রতি রাতকেই তিনি শবে কদর হিসেবে পান। মানে হলো নেক আমল ও সত্কর্ম দ্বারা সাধারণ সময়ও অসাধারণ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে ওঠে। আমরা জানি নতুন বছরে নির্ধারিত দোয়া পড়া হয় এবং নতুন মাসে নির্দিষ্ট দোয়া পড়া হয়। আসলে জীবনের প্রতিটি দিনই নতুন দিন, প্রতিটি সময়ই নতুন ; তাই এই দোয়াগুলোর গুরুত্বও সদা বিদ্যমান। যথা ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবছার ইয়া মুদাব্বিরাল্লাইলি ওয়ান্নাহার ; ইয়া মুহাওয়িলাল হাওলি ওয়াল আহওয়াল হাওয়িল হালানা ইলা আহ্ছানিল হাল। অর্থ হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ পরিবর্তনকারী! হে রাত ও দিনের আবর্তনকারী! হে সময় ও অবস্থা বিবর্তনকারী! আমাদের অবস্থা ভালোর দিকে উন্নীত করুন। আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ইমান, ওয়াছ ছালামাতি ওয়াল ইসলাম ; রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ ; হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র। অর্থ হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলাম সহযোগে আনয়ন করুন ; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের।
জিকির-আজকার, দোয়া-কালাম, দরুদ ও সালাম, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইস্তিগফার, খতম তিলাওয়াত, সদকা-খয়রাত ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে মাস অতিবাহিত করলে নিশ্চিত এর বরকত, ফজিলত ও কল্যাণ লাভ হবে। অন্যথায় সময়ের অপচয়ের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা করতে হবে। হাদিস শরিফে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন পরকালে নেককার মুমিন জান্নাতিগণের কোনো আফসোস থাকবে না ; বরং তাদের আফসোস থাকবে শুধু ওই সময়ের জন্য যে সময়গুলো তারা নেক আমল ছাড়া অতিবাহিত করেছে বা বেহুদা কাটিয়েছে। নবীজি (সা.)-প্রায়ই প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করতেন। কারণ এই দুই দিন বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পৌঁছানো হয়। বিশেষত সোমবারে জন্মগ্রহণ ও ওহি প্রাপ্তির শুকরিয়াস্বরূপ তিনি এই আমল করতেন। আমল দ্বারা সময়কে সুদ্ধ করা ও জীবনকে সমৃদ্ধ করা জ্ঞানীর কাজ। রাসুলে আকরাম (সা.)-বলেছেন তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করো-যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে, জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে। প্রিয়নবী (সা.)-এ দুদিন রোজা রাখার গুরুত্ব বর্ণনা করে ঘোষণা করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.)-করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহতায়ালার দরবারে) আমল পেশ করা হয়। সুতরাং আমার আমলসমূহ যেন রোজা পালনরত অবস্থায় পেশ করা হয় ; এটাই আমার পছন্দনীয়। আয়িশা (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজার প্রতি বেশি খেয়াল রাখতেন।
জমাদিউল আউয়াল মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-কালাম, দান-সদকাহ খয়রাত, ওমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত এ মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা। উল্লেখ্য, যেসব দিবসের ও যেসব মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেসব দিনে ও মাসে সবাই ইবাদত করবেন এবং করেও থাকেন-এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং যেসব দিন ও মাসের বিশেষ ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি, সেসব দিন ও মাসে বেশি করে নেক আমল করলে আমলকারী অবশ্যই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবেন ও অগ্রগামী হবেন। ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে : আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। আল্লাহপাক আমাদের এই ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ জমাদিউল আউয়াল মাসে বেশি করে নেক আমল করার তাওফিকে রাফিক এনায়েত করুন ও সকলকে প্রিয়নবী(সা.)-এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি-আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি ও জমাদিউল আউয়াল মাসে তওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন-পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত। প্রতিটি মাসের শুরু এবং শেষ বিশেষ দোয়া-কালাম ও নামাজ, রোজা এবং বিশেষ নেক আমলের মাধ্যমে পালন করা নবীজি (সা.)-এর সুন্নাত। আমল দ্বারা সময়কে রঙিন করা ও জীবনকে সাজানো বুদ্ধিমানের কাজ। সকলকে কবুল করুক আমিন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
মাহে জমাদিউল আউয়াল এর ফজিলত ও আমল
সংবাদটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন