হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.)-ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের এক মহান সাধক ও আধ্যাত্মিক জগতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় চিশতী তরিকার প্রবর্তক এবং ইসলামী সুফি মরমীধারার প্রসারে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখেন। নবী-রাসুলগনের ধারবাহিকতা সমাপ্ত হবার পর আরম্ভ হয় বেলায়তের সিলসিলা। ঠিক তেমনিভাবে পাক-বঙ্গ-ভারত তথা উপমহাদেশে হেদায়তের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খোরাসানের অন্তর্গত সঞ্জর নামক গ্রামে আতায়ে রাসুল হিন্দলঅলী খাজা গরীব এ-নেওয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। পাক ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে যার অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে তিনি হলেন সুলতানুল হিন্দ আতায়ে রাসুল গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাকে সুলতান-উল-হিন্দ (ভারতের সম্রাট) বলে অভিহিত করা হয়। তিনি গরিবে নেওয়াজ নামেও পরিচিত। কারণ গরিব মিসকিনকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
মহান আল্লাহতায়ালা দীন ইসলামকে হেফাজতের জন্য যুগে যুগে সংস্কারক প্রেরণ করেন যিনি দীন ইসলামকে যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে প্রকৃত আদর্শের উপর পূনঃ-প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের সোনালি ইতিহাসে এমন কিছু কীর্তিমান মহাপুরুষের আগমন ঘটেছে যাঁরা নিজেরাই ছিলেন একেকটি ইতিহাস। হেদায়তের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য গরীবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-মানুষের মনে খোদা-প্রেম জাগ্রত করার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তার আল্লাহ প্রদত্ত আধ্যাত্মিক শক্তির পরশে মানুষ আজ আলোর পথের পথিক।
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-১১৩৮ ইংরেজি-৫৩৭ হিজরীতে মধ্য এশিয়ায় খোরাসানের অন্তর্গত সিস্তান রাজ্যের সানজার নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ খাজা গিয়াস উদ্দীন,মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা মাহেনুর। পিতার দিকে তিনি শেরে খোদা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর চতুর্দশতম এবং মাতার দিকে তিনি খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা জোহরা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর দ্বাদশতম বংশধর। মাতৃকুল হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও পিতৃকুল হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত যাওয়ায় তিনি বংশে হাসানী-হোসাইনী আওলাদে রাসুলের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার অশেষ সৌভাগ্যের অধিকারী। তদুপরি তিনি উভয়দিকে অলিকুল সম্রাট গাউছুল আজম হযরত বড়পীর শায়েখ মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র-এর বংশধর। পিতৃকূল ও মাতৃকূল উভয় দিক থেকে। বস্তুত এসব কারণেই তিনি আল্লাহ প্রদত্ত অলৌকিক শক্তি বলে কামালিয়াতের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছিলেন। পরে স্বপরিবারে খোরাসান শহরে (বর্তমান আফগানিস্তান) হিজরত করেন। মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে বাবা-মা উভয়কেই হারান।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনে কারিমে মুখস্থ সম্পন্ন করেন। পরে জ্ঞানার্জনের জন্য প্রথমে সমরকন্দ ও পরে বোখারা গমন করেন। বোখারায় তিনি মাওলানা শরফুদ্দিন ও মাওলানা হাসান উদ্দিনের ন্যায় জগদ্বিখ্যাত আলেমদের কাছে পাঁচ বছর এলমে শরিয়তের জ্ঞান অর্জন করেন। পৈতৃকসূত্রে তিনি একটি ফলের বাগান লাভ করেছিলেন। সুফি ইব্রাহিম কান্দুজি নামক একজন আল্লাহওয়ালা বুজুর্গের সংস্পর্শে এসে তার জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি একজন মানবসেবক ও আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন।
খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রহ.)-হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন মক্কায়। হজ্ব পর্ব শেষ করে মক্কা শরীফ থেকে হযরত খাজা বাবা মদিনা শরীফে আসেন এবং অতি শ্রদ্ধাভক্তি এবং নম্রতার সহিত হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর রওজা শরীফে হাজির হন। রওজা পাকের খাদেম সাহেব তাকে রওজা শরীফে পৌঁছিয়ে আরজ করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা মঈন উদ্দীন চিশতি উপস্থিত। এ কথা বলা মাত্রই রওজা শরীফ এর দরজা নিজ হতেই খুলে গেল। হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা জ্যোতির্ময় চেহারায় আবির্ভুত হয়ে ফরমান : হে কুতুবে মাশায়েখ ভিতরে এসো। হযরত খাজা বাবা আত্মহারা হয়ে রওজা শরীফের ভিতরে প্রবেশ করলেন। তথায় নুর ও জ্যোতি দেখে তিনি বিমুগ্ধ ও বিমূঢ় হয়ে যান। যখন খাজা বাবা রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর হুশ অর্থাৎ জ্ঞান ফিরল তখন হুকুম হল হে মঈনুদ্দিন তুমি আমার দ্বীনের মঈন (সাহায্যকারী) আজ আমি তোমাকে হিন্দের বেলায়েত দান করলাম। তুমি হিন্দুস্থানে যাও এবং আজমির নামক স্থানে দ্বীনের প্রচার কর। খোদা তোমাকে বরকত দান করবেন। সুসমাচার শুনে পরিতৃপ্ত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রহ.)। পরক্ষনেই চিন্তিত হলেন তিনি। কোথায় আজমির ? বিশাল হিন্দুস্থানের কোন দেশে আছে রসূল নির্দেশিত আজমীর ? চিন্তিত অবস্থায় তন্দ্রাছন্ন হয়ে পরলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রহ.)। সেই অবস্থায় তিনি দেখলেন হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা তাঁর শিয়রে উপবিষ্ট। তিনি তাঁকে আজমীর শহরের দৃশ্য দেখিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশনা। এরপর দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা তাঁর হাতে দিলেন একটি সুমিষ্ট আনার। তারপর তাঁর জন্য দোয়ায়ে খায়ের করে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
তিনি ছিলেন রাসুলে করিম (সা.)-এর পূর্ণ অনুসারী। মানুষে মানুষে তিনি কোনো পার্থক্য করতেন না। বাদশাহ-ফকিরকে দেখতেন একই নজরে। এমনকি গরিবকে দিতেন তিনি প্রাধান্য। আমির লোকদের হাদিয়া তিনি গ্রহণ করতেন না। তবে গরিবের হাদিয়া গ্রহণ করতেন সন্তুষ্ট চিত্তে। জীবনে শাহি-দরবারে কখনো গমন করেননি। তাঁর দরবারে যত হাদিয়া উপস্থিত, হতো তিনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ লোকদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতেন। মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। তা দূর করার জন্য ব্যাকুল ছিলেন । তিনি বন্ধুবৎসল, বিনয়ী, মিষ্টভাষী ও অমায়িক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। অপরের সালামের অপেক্ষা তিনি করতেন না। আগেই সালাম দিতেন মুসাফাহার জন্য আগেই হাত বাড়িয়ে দিতেন।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত ও দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি-সাধকের সাথে সাক্ষাত করেন বলে নানা গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়। ভ্রমণের ধারাবাহিকতায় তিনি আরব থেকে ইরাক, ইরান ও আফগানিস্থান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন। ভারতবর্ষে তার আগমনে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। সামাজিক নানা কুসংস্কার শিরক ও বেদাতি কার্যকলাপ বিদূরিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় প্রচুর মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা। খাজা সাহেবের প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলের লাখ লাখ পথহারা সত্যবিমুখ মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তার এ সাফল্যের মূলে ছিল সুদৃঢ় ঈমান,কঠোর সাধনা ও নেক আমল। এছাড়া পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক, তেজোদীপ্ত প্রভাব বিস্থারকারী আধ্যাত্মিক শক্তি, আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ মানবসেবা, ইসলামি শিক্ষার পরিপূর্ণ বাস্থবায়ন ও তরিকার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রভৃতি। শুধু তাই নয়, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-ইসলামের বাণী সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে অনেক খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এসব খানকা ছিল উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। সাধারণত জ্ঞান-পিপাসুদেরই এসব খানকায় থাকার অনুমতি দেয়া হতো। উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করা সহজ হতো না। তবে একথা সত্য যে তার আগমনের বহু আগেই ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ঘটে এবং অনেক সুফিসাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু খাজা সাহেবের আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপবে রূপান্তরিত হয়। ভারতবর্ষে তার আগমনে সময়-মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সাধারণ মানুষ উচ্চ বর্ণের লোকদের দ্বারা নিগৃহীত হতো প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এসব জাতিভেদ এবং স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাওহিদের দর্শন প্রচার করেন। ফলে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-৬৩৩ হিজরীর ৫ই রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ই রজব সুবহে সাদেকের সময় ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। ওফাতের সাথে সাথে তাঁর পবিত্র কপাল শরীফ-এ স্পষ্টভাবে আরবীতে স্বর্ণোজ্বল নুরানী অক্ষরে লিখা হয়ে যায় “হাযা হাবীবুল্লাহ মা-তা ফি হুব্বিল্লাহ” অর্থাৎ ইনি আল্লাহর বন্ধু,আল্লাহর মুহব্বতেই তিনি বিসাল লাভ করেছেন। গরীবে নেওয়াজের বড় সাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী (রহ.)-তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.)-খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।
গরিবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর আদর্শিক জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। তাঁর আদর্শিক জীবনের সামান্য অংশ যদি আমরা পালন করতে সক্ষম হই। তাহলে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (সা.)-এর সন্তোষ্টি অর্জন সম্ভব। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সুলতানুল আউলিয়া হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর আদর্শ বাস্থবায়ন করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি আজমিরী সানজিরী (রহ.)’র জীবন দর্শন
সংবাদটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন