ঝিনাইদহের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার ঘাতক শিমুল ভূঁইয়া এবং ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবুর দেয়া তথ্যমতেই মঙ্গলবার মিন্টুকে ডিবি হেফাজতে আনা হয়েছে। আনার হত্যায় মিন্টু সম্পৃক্ত আছেন এমন বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ ডিবি আগেই পেয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ডিবি অনেকগুলো বিষয়েই তার কাছে জানতে চেয়েছে। তবে তিনি অনেক প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছেন না। তদন্ত কর্মকর্তা যেসব তথ্য পেয়েছেন সেগুলো মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সত্যতা যাচাই করছেন। অন্যদিকে মিন্টু নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডে তার কোনো দায় নেই বলে বুঝানোর চেষ্টা করছেন। ডিবির একটি সূত্র বলছে, মিন্টুর কাছ থেকে সদুত্তর মিলছে না। গ্যাস বাবু মোবাইল হারিয়েছে বলে যে জিডি করেছেন সেগুলোর সন্ধান পেয়েছে ডিবি।
আদতে মোবাইলগুলো হারায়নি। গ্যাস বাবু নিজের নিরাপত্তার জন্য সেগুলো মিন্টুর কাছে রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন সেখানে রাখলে ডিবিও উদ্ধার করতে পারবে না। এ ছাড়া গ্যাস বাবুও ডিবির কাছে স্বীকার করেছে শিমুল ভূ্ইয়াকে যে দুই কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল সেটির যোগানদাতা মিন্টু। ডিবি মনে করছে, আনার হত্যাকাণ্ডের পেছনে মিন্টুর বড় ধরনের স্বার্থ রয়েছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড আবেদন করা হতে পারে। ডিবি সূত্র বলছে, শিমুল ভূঁইয়ার জবানবন্দিতে আনার হত্যার জট খুলতে শুরু করেছে। তার জবানিতেই গ্যাস বাবু, মিন্টুসহ ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন আরও কয়েকজন নেতার নাম উঠে এসেছে। এখন গ্যাস বাবু ও মিন্টুকেও ওই নেতাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যদি সত্যতা মিলে তবে তাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সূত্র বলছে, পলাতক শাহীন, মিন্টু, গ্যাস বাবু ও ঝিনাইদহের সন্দেহভাজন আরও কয়েকজন নেতা মিলেই আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। মিন্টু ছিলেন অর্থের যোগানদাতা। কারণ আনারকে সরিয়ে দিলেই ঝিনাইদহ এলাকার একটি সংসদীয় আসন, আধিপত্য বিস্তার, চোরাচালান ব্যবসাসহ অনেক কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। ঝিনাইদহ এলাকায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে একক আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন আনার। বিশেষ করে ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে টানা তিনবার এমপি, চোরাচালান ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। আনারের জন্য মিন্টুর এমপি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছিল না। এই আসন থেকে আনার ছাড়া অন্য কেউ মনোনয়নও পাচ্ছিলেন না। তাই তাকে সরিয়ে দিলে এমপি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতো। এ ছাড়া চোরাচালান ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ আনারের কাছে থাকায় অন্য কেউ সুবিধা করতে পারেননি। তাই তারা চেয়েছিলেন বড় অংকের টাকা খরচ করেও যদি আনারকে সরিয়ে দেয়া যায় তবে মাঠ ফাঁকা হয়ে যাবে। এজন্য মিশন বাস্তবায়নে শিমুল ভূঁইয়া, সিয়াম, জিহাদ, শেলেস্তি, তানভির, মোস্তাফিজসহ আরেকটি গ্রুপকে তৈরি করে শাহীন। আগে থেকেই শাহীন ও শেলেস্তি স্বামী-স্ত্রী সেজে ভাড়া নেন সঞ্জীবার ওই বাসা। পরে কৌশলে লোভ দেখিয়ে ফাঁদ পেতে আনারকে নেয়া হয় ওই ফ্ল্যাটে। পরিকল্পিতভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
ঝিনাইদহের প্রভাবশালী এই নেতা আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে রেহাই পেতে বিভিন্ন মহল থেকে তদবির করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন, কোনো চাপে যেন বিচার বন্ধ না হয়। এ সময় তিনি জড়িতদের ছাড়িয়ে নিতে তদবির হচ্ছে, বড় বড় জায়গা থেকে ফোন আসছে- এমন কথাও বলেন। ডরিন বলেন, আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এসেছি যেন আমার বাবা হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার হয়। সঠিক বিচারটা যাতে আমাকে নিশ্চিত করেন, সেই দাবি জানাতে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এরই মধ্যে অনেককে আটক করা হয়েছে। আমি শুনেছি, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক জায়গা থেকে তদবির করা হচ্ছে। তাদের যেন ছেড়ে দেয়া হয়, সেজন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কোনো তদবিরের চাপে পড়ে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে বন্ধ করার চেষ্টা না হয়, চাপের মুখে যাতে সঠিক তদন্ত বন্ধ করা না হয়, সেই দাবি জানিয়েছি। আমি সঠিক বিচার চাই। গ্যাস বাবু নামে যাকে আটক করা হয়েছে, তিনি আমার বাবার প্রতিপক্ষ নয়। আমাদের সঙ্গে তার কোনো শত্রুতাও নেই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। গত ১৭ই মে তার সঙ্গে ভাঙ্গায় দেখা হয়েছে, সেখানে একটা টাকা দেয়ার লেনদেনের কথা উঠেছে, যা আমি খবরে শুনেছি। আমার কথা হলো, এই টাকার জোগানদাতা কে? কেন তারা এটা করিয়েছে? আপনারা দেখেছেন, তাকে আটকের আগে থানায় তিনি জিডি করেছেন যে তার ৩টি ফোন হারিয়ে গেছে। একইদিনে একজন মানুষের ৩টি ফোন কীভাবে হারিয়ে যায়, সেটাও আমার প্রশ্ন। এগুলো কী পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, সে তো আমার বাবার শত্রু নয়। এই কাজগুলো কে করাচ্ছে, সেটা আমি বারবার বলেছি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু চাচাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি নিয়ে গেছে। অবশ্যই তাদের কাছে সত্যিকারের কোনো তথ্য-প্রমাণ আছে, সেটা আমি নিজেও জানি। সেই প্রমাণ সাপেক্ষেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আসলে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। সঠিক বিচারের আশ্বাস দিয়ে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যেটা আইনে আসবে, যেটা সত্য, সেটার বিচার হবে। আমি বিশ্বাস করি, অপরাধীদের তিল পরিমাণ ছাড় দেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে আনার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর কাছে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণের পরেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্টুকে ডাকা হয়েছে। মিন্টুর কাছে তথ্যগুলো জানতে চাওয়া হবে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে যদি মিন্টু সদুত্তর দিতে পারেন তবে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর যদি কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারে তদন্তের ধারাবাহিকতায় যা করার তাই করা হবে। বিভিন্ন তথ্য-উপাথ্যের ভিত্তিতে গ্যাস বাবুকে নিয়ে আসি। আমরা যখন কাউকে নিয়ে আসি অবশ্যই কিছু তথ্য-উপাত্ত থাকে। প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদে গ্যাস বাবু অকপটে স্বীকার করে যে, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়া ঘাতক শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে গ্যাস বাবু মিটিং করেছিল। শিমুল ভূঁইয়া গ্যাস বাবুকে এমপি আনার হত্যার পর ছবি দেখিয়েছে। ১৬ তারিখেই যদি হত্যাকাণ্ডের তথ্য মিন্টু ও গ্যাস বাবু জেনে থাকেন তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তারা কেন জানালো না? এটিও অপরাধ। এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, হ্যাঁ এটি সঠিক। কেন তারা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গোপন করলেন এটিই জানতে চাওয়া হবে। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দু’জনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। এমন আরও কতোজন রাজনৈতিক ব্যক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে হত্যাকাণ্ডের পেছনে? জবাবে হারুন বলেন, গ্যাস বাবু রিমান্ডে রয়েছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, যারা নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এটাও বলে রাখতে চাই, কারও প্ররোচনায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিতে কোনো হয়রানি করা হবে না। তদন্তকারী কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে প্রতিটি মামলার ঘটনা তদন্ত করছেন জানিয়ে হারুন বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের উপর কোনো চাপ প্রয়োগ করে না। কারণ তারা জানে ডিবি প্রত্যেকটি চৌকস টিম মামলার তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধী দেশে কিংবা বিদেশে থাকলেও তাদেরকে খুঁজে বের করে আনে। কোনো নিরীহ লোককে হয়রানি করার প্রশ্নই আসে না।