সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে রোববার (১৪ জুলাই) বিকেলে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করে গেছে, পিয়ন, যে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। হ্যাঁ, এটা বাস্তব কথা। তো কী করে বানাল এই টাকা! যখনই আমি জেনেছি, তাকে বাদ দিয়ে কার্ড-টার্ড সব সিজ করে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ওই পিয়নের পরিচয় নিয়ে কোনো ইঙ্গিত দেয়া না হলেও এরই মধ্যে চাউর হয়েছে, তার নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘পানি জাহাঙ্গীর’। নোয়াখালীর চাটখিল থানার খিলপাড়া ইউনিয়নে তার বাড়ি। বাবা মৃত রহমত উল্ল্যাহ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে সুধাসদনে কাজ করতেন জাহাঙ্গীর। তিনি সেখানে আগত অতিথিদের পানি এগিয়ে দিতেন। এই কারণে তার নাম হয় ‘পানি জাহাঙ্গীর’।
পরবর্তীতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। লাইসেন্সকৃত পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন তদবিরের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। নোয়াখালী ও ঢাকায় গড়েছেন বিপুল সম্পদ।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। তার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে বলা হয় প্রজ্ঞাপনে।
রাজনীতিতে নেমে চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নেন জাহাঙ্গীর। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার জন্য নমিনেশনও তুলেছিলেন। সেটা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করেন। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশাল বহর নিয়ে সভা-সমাবেশও করেছেন। যদিও পরবর্তীতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে যেতেন জাহাঙ্গীর। যাতায়াতের জন্য তিনি ব্যবহার করতেন হেলিকপ্টার।
রাজধানীতে জাহাঙ্গীরের একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে বলেও জানা গেছে। তার স্ত্রীর নামে আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে ধানমন্ডিতে। নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে আটতলা বাড়ি রয়েছে জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর নামে।
ধানমন্ডির আলিশান ফ্ল্যাট ছাড়াও মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে জাহাঙ্গীরের। মিরপুরে আছে সাততলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট।
সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় কৃষিখাত থেকে প্রতি বছর ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য দেন তিনি। সবমিলিয়ে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয়ের কথা জানান।
নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, ব্যাংকে জাহাঙ্গীরের নামে আড়াই কোটি টাকা এবং তার স্ত্রীর নামে সোয়া ১ কোটি টাকা রয়েছে। ডিপিএস আছে পৌনে ৩ লাখ টাকা এবং এফিডিআর রয়েছে সোয়া ১ কোটি টাকা। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও আছে।
অভিযোগ আছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত সহকারীর পরিচয় দিয়ে টেন্ডারবাজি, তদবির, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করেন জাহাঙ্গীর।
এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার জাহাঙ্গীরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।