পুরনো রাজনৈতিক বার্তাই ফের স্পষ্ট করে গেলেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দাঁড়িয়ে ল্যাভরভ কূটনৈতিক ভাষায় রীতিমতো একহাত নিলেন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়াকে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা চাপে বাংলাদেশ যে তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ওপর অটল রয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বললেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের মধ্যেও বাংলাদেশ তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রণীত ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কড়া সমালোচনাও করেন তিনি। বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে প্রতিহত ও রাশিয়াকে একঘরে করতে চায়। এটি তাদের কথিত স্ট্র্যাটেজির উদ্দেশ্য। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে দু’দফা বৈঠক হয় রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘসহ নানা প্ল্যাটফরমে রাশিয়া কাজ করছে জানিয়ে বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গেও আমরা এ নিয়ে আলোচনা করছি, যা অব্যাহত থাকবে।
এ ইস্যুতে পশ্চিমারা চাপ দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাকার্তা থেকে বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকা আসেন ল্যাভরভ। দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেয়ার পথে কয়েক ঘণ্টা বাংলাদেশে কাটিয়ে গেলেন। এটি ছিল রাশিয়ার কোনো মন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। সফরকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে একান্ত এবং আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয় তার। তাছাড়া জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখেন। দুপুরে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের আগে রাশিয়ান দূতাবাসে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করা বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। স্মরণ করা যায়, গত বছরের নভেম্বরে ল্যাভরভের ঢাকা সফরের কথা থাকলেও শেষ সময়ে এসে তা বাতিল হয়ে যায়।
মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার: রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অ্যাডহক ওয়ার্কিং গ্রুপের আলোচনাকে সমর্থন করি। তিনি বলেন, বাইরের কিছু শক্তি এই ইস্যুকে ব্যবহার করে একটি পক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়টি সামনে আনছে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করছে। রাশিয়া মনে করে দুটো উদ্যোগই হিতে বিপরীত হবে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারে রাশিয়া আগ্রহী জানিয়ে ল্যাভরভ বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যতম প্রধান অংশীদার এবং পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেন। সেই সঙ্গে জানান, সর্বস্তরে দু’দেশের সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন। রাজনৈতিক সম্পর্ক কার্যকরভাবে জোরদারের সম্ভাব্য সব ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাণিজ্য করতে ও রূপপুরে অর্থ পরিশোধে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তার সমাধান নিয়েও কথা বলেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে ল্যাভরভ বলেন, রূপপুরের অর্থসহ অন্যান্য বাণিজ্য বাংলাদেশ ও রাশিয়া নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবহার করে পরিশোধ হবে। তার ভাষ্যটি ছিল এমন ‘আমরা খুব শিগগিরই অর্থ পরিশোধের উপায় খুঁজে বের করবো। আর এ অর্থ নিজস্ব মুদ্রায় পরিশোধ করা হবে। আমরা এমন কারও মুদ্রা ব্যবহার করবো না, যারা এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।’ বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানানোয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, গত ৫০ বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও সমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। করোনা মহামারিসহ অন্যান্য কঠিন সময়ের মধ্যেও বাংলাদেশ ও রাশিয়া রাজনৈতিক সংলাপ চালিয়ে গেছে। ফলে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সব ক্ষেত্রে আরও গভীর হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ফ্যাগশিপ প্রকল্প উল্লেখ করে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে। আশা করি অক্টোবর মাসে এর জ্বালানি এসে পৌঁছাবে। এ ছাড়া আমাদের প্রতিশ্রুত কিছু গ্যাস ভিত্তিক প্রকল্প রয়েছে, তা নিয়েও কাজ চলছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রমের গ্যাসকূপ খনন অব্যাহত রাখা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। রাশিয়া থেকে ভবিষ্যতে গম ও সার বিক্রির বিষয়ে স্থায়ী রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আলোচনার মাধ্যমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর: এদিকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাৎ করতে যান রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি হাসান জাহিদ তুষার সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রক্সি ওয়ার চায় না বাংলাদেশ- পররাষ্ট্রমন্ত্রী: এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের উপস্থিতিতে মস্কোর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সাফ জানান, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে কোনো প্রক্সি ওয়ার দেখতে চায় না। বাংলাদেশ যে কোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন উপায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমরা ভারসাম্য কূটনীতি মেনে চলার চেষ্টা করি। আমরা আমাদের আগ্রহকে গুরুত্ব দিই। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা আলোচনার মধ্যে অনেক ইস্যু তুলে নিয়ে এসেছি। আমাদের ইস্যু ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এটা মোটামুটি যথা সময়ে শেষ হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ইস্যুতে রাশিয়া আমাদের সঙ্গে একাত্ম। রাশিয়া বাংলাদেশকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেল আনার প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে আবদুল মোমেন বলেন, তাদের দেশ থেকে আমরা এলএনজি আনতে পারি। তারা আমাদের প্রস্তাব করেছেন, তাদের দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল আনতে পারি। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, তাদের দেশে অর্থনৈতিক একটা কমিশন আছে, আমরা তার সুবিধা নিতে চাই। বাকি রাষ্ট্র যারা সদস্য, বিশেষ করে তাজিকিস্তান, তাদের অনুমতি লাগবে। সবাই মিলে যেন সিদ্ধান্ত নেয়।


