গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমালোচনা থাকবেই। থাকতে বাধ্য। একমাত্র চরম কর্তৃত্বপরায়ণ বা নিষ্ঠুর একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সমালোচনার কোনো স্থান নেই। সেখানে থাকবে শুধুই বন্দনা, গুণগান আর প্রশংসা। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত রাজনীতিবিদদের ও তাদের কর্মীদের, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের সমালোচনা সহ্য করার মন ও মানসিকতা থাকতে হবে। নতুবা সুন্দর সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়েই উঠবে না বা কোনো রকম গড়ে উঠলেও তা মোটেই লাগসই হবে না বা স্থায়ীত্ব পাবে না। রাষ্ট্র ও সরকার যারা চালান তারা তো রক্ত-মাংসে মানুষ, ফেরেশতা নন নিশ্চয়ই। তাছাড়া তারা নবী ও রাসুলদের মতো নির্ভুল ওহী (ঐশিবাণী) দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও নন! সুতরাং তাদের ভুল হবেই এবং হতে বাধ্য। কেননা মানুষমাত্রই ভুল হয়, ভুল করে। আর ভুল হলে সমালোচনা করতেই হবে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, এমন কী তাদের (অর্থাৎ ভুলকারীদের) নিজেদের স্বার্থেও! সমালোচনা না করলে তারা তাদের ভুল বুঝবে কিভাবে বা ভুল বুঝে শোধরাবে কিভাবে?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমালোচনার অধিকার দেয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন তথা সংবিধান।
বাক্স্বাধীনতা, কথা বলার অধিকার ও সমালোচনা করার অধিকার হচ্ছে জনগণের সহজাত, মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কিছু শর্ত সাপেক্ষে ৩৯(২)(ক) অনুচ্ছেদ প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। লেখালেখি ও সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৯(২)(খ) অনুচ্ছেদে লেখক ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
এ অধিকার সব সময়ের জন্য – শান্তির সময়, এমন কী মহামারী বা চরম ক্রান্তিকালেও। এই সহজাত অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। সমালোচনা শুনে তেড়ে আসলে হবে না বরং সমালোচনার জবাব দেয়া উচিৎ নিজেদেরকে সংশোধন করে অথবা নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে অথবা নিজেদের কর্মকাণ্ড ও কর্মতৎপরতার পক্ষে সঠিক তথ্য ও যুক্তি দিয়ে। জোর করে, ভয় দেখিয়ে, নির্যাতন করে বা মামলা দিয়ে বা মামলার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখা বা সমালোচনাকে স্তব্দ করা কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
তবে হ্যাঁ, সমালোচনা হতে হবে ইতিবাচক, গঠনমুলক, যৌক্তিক ও সঠিক এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে। সমালোচনায় মিথ্যা, কুৎসা রটনা বা মানহানিকর কিছু থাকলে, তারও সুরাহা করতে হবে যথাযথ পদ্ধতি (Due process) অনুসরণ করে নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের (যথা, আদালত বা স্বাধীন কমিশন) মাধ্যমে। এগুলো নিরূপণের দায়িত্ব কোনোভাবেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারী প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তাদের উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাদের কাছে ছেড়ে দিলে বরং সমালোচনাকারীরা শুধুমাত্র সমালোচনার কারণে হবে নির্যাতন ও নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সমালোচনায় দ্বিমত, ভিন্নমত ও ভিন্ন ডাইমেনশন থাকা স্বাভাবিক বিধায় এগুলোকে সব সময় রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করাই শ্রেয়। আদালতকে এগুলোতে টেনে এনে আদালত ও বিচার পদ্ধতিকে বিতর্কিত করা সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
সমালোচনার বিপরীতে আছে একমাত্র আলোচনা আর শুধু গুণগান ও প্রশংসা। ইতিহাস সাক্ষী এগুলো মোটেই সঠিক নয় এবং ভালো পরিণতি নিয়ে আসে না। খয়েঁর খাঁর মতো শুধু বন্দনা আর প্রশংসার স্তুতি করতে থাকলে ক্ষমতাসীনরা জানতেই পারবে না বা টেরই পাবে না তারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, কোথায় তারা ভুল করছেন! পায়ের নিচে মাটি না থাকলেও খয়েঁর খাঁদের গুণগান ও বন্দনার জন্য মনে করবেন তারা জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন! আর এটি তাদের নিজেদের জন্য এবং দেশের জন্য এক সময় মারাত্মক পরিণতি নিয়ে আসবে যা কল্পনাতীত। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমালোচনা রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাসীনদের জন্য অলংকার স্বরূপ যা তাদেরকে সঠিক পথে বা ট্র্যাকে চলতে ও রাখতে সাহায্য করে।
আমরা যারা গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে মেইনস্ট্রিম রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছি বা ছিলাম তারা তো অহরহ বৃটিশ সরকারের, বিশেষ করে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কঠোর ভাষায় সমালোচনা করি ও করছি। কই, আমাদেরকে তো কেউ বারণ করছে না, অসুবিধা হওয়া তো দুরের কথা। এটাই সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা। যেমন ধরুন ফেলে আসা বিশ্বব্যাপী মহামারীতেও ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে বিরোধীদল লেবার পার্টি যথাযথ (ক্ষেত্র বিশেষে কঠোর ও মারাত্মক) সমালোচনা করছে পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্টের বাহিরে উভয় জায়গায়। রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতিবিদদের সমালোচনা রুখতে এখানে কোনো আইন তৈরি করা হয় না। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করতে এখানে নেই কোনো কালো আইন। মানহানীর মামলা আদালতে গেলে বিচারকদের সাধারণত বাক্স্বাধীনতার পক্ষে (Pro- freedom of speech) তাদের মনোভাব বা অবস্থান পরিলক্ষিত হয় এবং নেহায়ত জরুরি না হলে তারা বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না।
অনেক সময় ক্ষমতাসীনরা ভাবেন সমালোচনা শুধুই আমাদের ব্যাপারে কেন? অন্যদের ব্যাপারে নয় কেন? বিশেষ করে বিরোধী দলের ব্যাপারে নয় কেন? অথচ তারা ভুলে যান যে – ক্ষমতায় যারা থাকেন সমালোচনা তো তাদেরই হবে। যারা ক্ষমতায় নেই তাদের সমালোচনা করে লাভ কী? তাদের কিই-বা করার আছে! রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, শক্তি ও প্রটোকল তো তাদের নেই। যেখানেই ক্ষমতা সেখানেই থাকে অপব্যবহারের সুযোগ ও সম্ভাবনা। ক্ষমতা যত বেশি, অপব্যবহারের সম্ভাবনাও তত বেশি। যেমনটি Lord Acton বলেছেন এভাবে “Power tends to corrupt, absolute power corrupts absolutely” (অর্থাৎ “ক্ষমতা দুর্নীতির দিকে ঝোঁকায়, নিরংকুশ ক্ষমতা নিরংকুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে”) তাই অপব্যবহার ও দুর্নীতির সম্ভাবনা ও বাস্তবতা থেকেই তো সমালোচনার ক্ষেত্র ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যুগে যুগে ক্ষমতাসীনরা সমালোচনাকে ভয় পান। তাই তারা সমালোচনাকে রুখতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের কালো আইন ও কানুন তৈরি করেন যার ব্যবহার হয় মূলত: বিরোধী মত, পথ ও দলের মানুষের বিরুদ্ধে। অতীতে ছিল বিশেষ ক্ষমতা আইন ও জননিরাপত্তা আইন। আর হাল আমলে করা হয়েছিল আইসিটি এ্যাক্ট, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অতি সম্প্রতি প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন। ক্ষমতাসীন সরকারকে জবাবদিহীতা নিশ্চিত করার কয়েকটি উপাদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জনগণের মতামত, সিভিল সোসাইটির সমালোচনা, সাংবাদিকদের লেখালেখি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা। এগুলো বন্ধ করতে আইন সাজানো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য দু:খজনক। আর এগুলো করলে সমাজ উদার, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠে কর্তৃত্বপরায়ণ, নিবর্তনমূলক ও ভীতিকর।
ক্ষমতাসীনদের উচিত সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি জনস্বার্থবিরোধী এমন কিছু না করা যা তাদের সমালোচনার মুখে ফেলতে পারে৷ ক্ষমতাসীনরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, নয় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ৷ তাদের ভালো কাজের প্রশংসা যেমন স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত, তেমনি দৃশ্যত প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত কাজের বিপুল সমালোচনাও অস্বাভাবিক নয়৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এসবের প্রয়োজনীয়তা আছে৷ আইন করে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই উচিত নয়।
উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে। আর সেই বিরোধী দলের প্রধান কাজই থাকে সরকারের সমালোচনা করা এবং সাথে সাথে জনগণের সামনে তাদের বিকল্প উপায় বা কর্মপন্থা উপস্থাপন করা। সুন্দর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় “সরকারী দল” ও “বিরোধী দল”কে তুলনা করা হয় দ্বি-চক্র (দুই চাকার) যানের (যানবাহনের) সাথে যার একটি চাকা অচল হলে পুরো যানই বিকল হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল (তথাকথিত বিরোধী দল নয়, সত্যিকার বিরোধী) হবে একে অপরের পরিপূরক, কাজ করবে একই যানের দুই চাকার মতো। সেই দুই চাকার যানের ১৮ কোটি যাত্রীর এই প্রত্যাশা।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার ও লন্ডন বারা অব নিউহ্যামের সাবেক ডেপুটি স্পীকার।


