মিজা ইমতিয়াজ শাওন:
কর্ণফুলী নদীর দুইপাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে ও সহজ যোগাযোগ নিশ্চিত করতে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা হলো। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম যোগাযোগ পথ-টানেল এখন উদ্বোধনের জন্য প্রায় সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। আজ শনিবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে গণমাধ্যমকর্মীদের টানেল এবং এর সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখানো হয়। এ সরকারের উন্নয়ন-সাফল্যে আগামীকাল যুক্ত হতে যাচ্ছে আরেকটি সোনালি পালক। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ উদ্বোধনের মাধ্যমে টানেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। দেশবাসী পরিচিত হতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেলের সঙ্গে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন।
এর আগে এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি বলেন, পৃথিবীর সম্ভাবনাময় দুটি অর্থনৈতিক জোট সার্ক ও আশিয়ানের সংযোগস্থল চট্টগ্রাম। তাই আঞ্চলিক যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্প্রসারণে এ শহরের গুরুত্ব অনেক বেশি। চট্টগ্রাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শত শত বছরের ঐতিহ্যের অধিকারী। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বণিকরা এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বেড়েছে। ’দেশের একমাত্র বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র দেশের প্রাচীন বাণিজ্যনগরীতে নির্মিত হওয়াতে চট্টগ্রামবাসী গর্ব অনুভব করবেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানকার প্রকল্প বাস্তবায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করেছি। পাঁচ তারকা মানের হোটেল নির্মাণ হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আরো বেশি প্রাণ ফিরে পাবে।
দুই দফা ব্যয় সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পে ব্যয় হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেলের ভেতরে থাকা দুটি টিউব বা সুড়ঙ্গের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার করে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে চীন সফরে গেলে সেখানে চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে দুদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা প্রসিডেন্ট সি জিনপিং যৌথভাবে টানেল বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। এ টানেল নির্মাণ কাজের মহাযজ্ঞ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা পর্যন্ত প্রথম টিউবের খনন কাজ সম্পন্ন হয় ২০২০ সালের ২ আগস্ট। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর আনোয়ারা থেক পতেঙ্গামুখী দ্বিতীয় টিউবের কাজ শুরু হয়ে পরবর্তী বছরের ৭ অক্টোবর তা সম্পন্ন হয়। এরপর শুরু হয় পূর্ত ও ইলেক্ট্রমেকানিক্যাল কাজ।
টানেল পাড়ি দিতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ মিনিট সময় লাগবে। সময়ের হিসাবে তা ‘অল্প’ হলেও এর জন্য নানা ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে টানেল বাস্তবায়নকারী সেতু কর্তৃপক্ষের। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পণ্যবাহী গাড়িগুলো গোলচত্বর দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমেই চলে যাবে বাঁ পাশে। সেখানে রয়েছে স্ক্যানার। স্ক্যানিং শেষে গাড়িগুলো চলে আসবে ওজন স্কেল এলাকায়। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ করে তারপর সোজা মূল টানেলে ঢুকে যাবে এসব গাড়ি।
তবে কার, মাইক্রোবাস, বাসসহ এ ধরনের পরিবহনের জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। স্ক্যানারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে ইউভিএসএস (আন্ডারভেহিকেল স্ক্যানিং সিস্টেম)।
টানেলের সর্বোচ্চ গভীরতা নদীর তলদেশ থেকে ৩১ মিটার। অর্থাৎ প্রায় ৯ তলা ভবনের সমান উচ্চতা। আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে টোল প্লাজা। সেখানে যাতে গাড়ির জট না হয়, সে জন্য অন্তত ২০টি টোল বক্স রয়েছে। টানেলের টোল প্লাজা পার হয়ে সংযোগ সড়ক দিয়ে গাড়ি চলে যাবে পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়কের চাতরী এলাকায়।
টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, টানেলটি চট্টগ্রাম নগরীকে চীনের সাংহাই নগরীর মতো ‘দুটি শহরকে একটি নগরীতে’ পরিণত করবে এবং এটি দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করবে। শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাবে এবং নগরীর পরিধি প্রসারিত করার মাধ্যমে সমগ্র অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটাবে।
বঙ্গবন্ধু টানেলকে দেশের সমৃদ্ধির জন্য নতুন একটি উল্লেখযোগ্য দিক হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। টানেল প্রতিষ্ঠার পর বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের আরও বিস্তৃতি ঘটবে। ব্যবসা ও শিল্পে ঘটবে সমৃদ্ধি। অর্থনীতির ভিত হবে আরও মজবুত। এ ছাড়া উত্তর প্রান্তে অবস্থিত আনোয়ারা উপজেলা একটি উপশহরে রূপ নেবে। আনোয়ারায় আগে থেকে রয়েছে বহুজাতিক কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল), কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড), মেরিন একাডেমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ ছাড়া সেখানকার গহিরায় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে চায়না ইকোনমিক জোন। এ জোন প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে হবে ১৭১টি শিল্প-কারখানা। কর্মসংস্থান ঘটবে লক্ষাধিক মানুষের। টানেল সৃষ্টির ফলে চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে ১৫ কিলোমিটারের বেশি। আনোয়ারা উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম শহরে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহরেই পৌঁছানো যাচ্ছে। যেখানে পূর্বে পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগত।
বঙ্গবন্ধু টানেলের পরবর্তীতে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে জমি ক্রয় করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ। সরেজমিনে কালাবিবির দীঘি থেকে চাতরী চৌমুহনী পর্যন্ত সড়কটি ঘুরে দেখা যায়, গত দুই বছরে বদলে গেছে এই এলাকাটির চিত্র। যেখানে বছর দুয়েক আগেও দু’তলা ভবনও ছিল না সেই কালাবিবির দীঘি এলাকায় গত দুই বছরে নির্মিত হয়েছে অন্তত ২০টি বাণিজ্যিক ও আবাসিক বহুতল ভবন। নির্মাণাধীন রয়েছে অন্তত ১০টি বানিজ্যিক ভবন। গড়ে উঠেছে ক্লিনিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স, উন্নত মানের রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার। অ্যাপ্রোচ রোড সড়কের কাছাকাছি এলাকায় প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল পোশাক কারখানা এইচএস কম্পোজিড টেক্সটাইল। আশা করা হচ্ছে এই পোশাক কারখানায় তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।


