দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন ও চালকের হাতে নামমাত্র ফিতে লাইসেন্স প্রদান করা গেলে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নীতিমালা প্রণয়নসহ ৮ দফা সুপারিশও জানায় সংগঠনটি।
সোমবার (২৫ নভেম্বর) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জরুরিভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ছোট যানবাহন চলাচল নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবি জানান।
তিনি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে দেশে ইজিবাইকের বিস্তার লাভ করলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি এই খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি নানান ফোরামে প্রস্তাব তুলে ধরেন। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে সারাদেশে ৪০ লাখ অটোরিকশা থেকে দৈনিক ১১০ কোটি টাকা করে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে চাঁদাবাজি হয়েছে। এই চাঁদাবাজির কারণে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ দেশের সকল সড়ক-মহাসড়ক, নগর-বন্দরে মোটরচালিত অটোরিকশা দৌরাত্ম্য বেড়ে চরম আকার ধারণ করেছে।
পতিত সরকারের অনেক এমপি, মন্ত্রীও এই অবৈধ অটোরিকশা পরিচালনা করে অবৈধ চাঁদাবাজিতে যুক্ত ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলে, এতে এই খাতের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। অবাধে আমদানি, স্থানীয় গ্যারেজে সহজলভ্য ভাবে তৈরি করে সহজে রাস্তায় নামানোর অবাধে সুযোগ থাকায় এবং দেশে অন্যান্য খাতে সহজে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় স্বল্প পুঁজিতে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ অটোরিকশা কিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। এতে কৃষিখাতে শ্রমিক সংকটসহ কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। প্রশিক্ষণবিহীন লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের হাতে এসব অটোর স্টিয়ারিংয়ের কারণে সড়ক নিরাপত্তায় ভয়ানক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দেশের হাসপাতালগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তির চিত্র পর্যবেক্ষণে দেখেছে, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ভয়াবহভাবে বাড়ছে। ২০২৩ সালে জাতীয় অর্থোপেডিক (পঙ্গু হাসপাতাল) হাসপাতালে ১৪ হাজার ৩৫৭ জন , চমেক হাসপাতালে ৯ হাজার ৮৭৯ জন, কুমেক হাসপাতালে ৬ হাজার ৭৪৮ জন, খুমেক হাসপাতালে ৯ হাজার ২৯৩ জন, ঢামেক হাসপাতালে ৪ হাজার ৭৮৪ জন, নারায়ণগঞ্জের খাঁনপুর হাসপাতালে ৪ হাজার ৫৮৩ জন, পিজি হাসপাতালে ৩ হাজার ৫৬৩ জনসহ এই ৭ হাসপাতালে ৫৩ হাজার ২০৭ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হয়েছে।
এছাড়াও দেশে ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৭ জন হারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হচ্ছে। দেশে সরকার নিবন্ধিত ৪ হাজার বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩ জন হারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হচ্ছে। সারাদেশের এমন ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র মোটরসাইকেলের বাণিজ্যিক ব্যবহার, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বেপরোয়া হারে বাড়ানোর কারণে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরে দেশের সড়ক থেকে ট্রাফিক পুলিশ উঠে গেলে এসব অটোরিকশা আরও বেপরোয়া হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল শুরু করে জানিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, এতে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট চরম আকার ধারণ করায় নতুন সরকার এমন ভয়াবহ যানজট কমাতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে মোটরচালিত অটোরিকশাসহ অযান্ত্রিক যানবাহন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেন। এ পরিস্থিতিতে গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট ৩ দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধি নিষেধ আরোপ করার নির্দেশ দেন। এরই প্রেক্ষিতে সরকার রাজধানী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ করতে গেলে পুরো রাজধানীর লাখ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক ও মালিকেরা সংগঠিত হয়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক পথ ও রেলপথে যান চলাচল বন্ধ করে দেন।
এতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। দেশের এক চরম অস্থির সময়ে নির্বাহী বিভাগের কাজে বিচার বিভাগ এগিয়ে আসা। মাত্র ৩ দিনের মধ্যে রাজধানী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ বা নিয়ন্ত্রণের আদেশ দিয়েছেন আমরা এই আদেশ পুনর্বিবেচনার হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, বলেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব।
তিনি বলেন, সরকার ২০২১ সালে থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১’ নামে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে। অথচ করোনা সংক্রমণে গণপরিবহন বন্ধ থাকার সুবাদে ২০২১-২০২২ সালে প্রায় ৮ লাখ হারে দুই বছরে ১৬ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ১০ লাখ হারে ২০ লাখ মোটরসাইকেল রাস্তায় নামে।
তিনি বলেন, সারাদেশে এইসব যানবাহনের কারণে সৃষ্ট যানজট ও দুর্ঘটনা দ্বিগুণ হলেও অদৃশ্য কারণে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি চূড়ান্ত করেনি। ভারত থেকে একচেটিয়া হারে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাহিন্দ্রা, অটো টেম্পু, হিউম্যান হলার আমদানি অব্যাহত রাখার স্বার্থে তৎকালীন সরকার এই নীতিমালা থেকে সরে এসেছিলেন। তবে বর্তমানে জরুরি ভিত্তিতে এই নীতিমালা প্রণয়ন দরকার।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে ৮ দফা সুপারিশও জানায় যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এগুলো হলো-
১) জরুরিভিত্তিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১’ এর খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে।
২) বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার বডি মডিফাই করে ব্রেক ও গতির সমতা এনে সড়ক নিরাপত্তায় ঝুঁকিমুক্ত নিশ্চিত করে সার্টিফাইসহ নিবন্ধন নিতে হবে।
৩) সড়কের সক্ষমতা বিবেচনা করে সিলিং নির্ধারণ করতে দেশের সকল সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে, বিআরটিএর নিয়ন্ত্রণে তাদের আওতাধীন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন প্রদান করতে হবে।
৪) প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার চালককে ন্যূনতম ১ সপ্তাহের সড়ক আইনকানুন, ট্রাফিক চিহ্ন, সড়কে মোটর রিকশা চলাচল পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারীদের নামমাত্র ফি নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। হুট করে গ্রাম থেকে এসে প্রশিক্ষণহীন কোন ব্যক্তি যাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫) প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে জিপিএস লাগানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানীর প্রধান সড়ক, দেশের হাইওয়ে বা উপজেলা ও পৌরসভার প্রধান সড়কের যেটুকু অংশ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে সেই সড়কে প্রবেশ করা মাত্র জিপিএসের মাধ্যমে ট্রাফিক বিভাগ অটো জরিমানা আদায় করতে পারবে এমন পন্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬) ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা জাতীয় মহাসড়কে চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭) জরুরিভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে হবে।
৮) ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে প্রতিটি এলাকার নিবন্ধন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতামত এবং যাত্রী সাধারণের সঙ্গে গণশুনানি করে এলাকাভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, রিকশা,ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন, চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক থ্রি হুইলার যানবাহন মালিক ও চালক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. সিদ্দিক মিয়া প্রমুখ।
