মোঃ নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাই (রাঙামাটি): ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত চন্দ্রঘোনা সবুজ সংঘ ক্লাব এক স্মরণীয় ইতিহাসের নাম। ২৫ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার এক থেকে দেড় মাস আগেই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছিল কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনাস্থ এই ক্লাবে৷ ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সবুজ সংঘ ক্লাবটিই মহান মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিল অনন্য অবদান। যেই ক্লাবেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর অসংখ্য স্মৃতি।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে ক্লাবটির ইতিহাস তুলে ধরেন কাপ্তাইয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সবুজ সংঘ ক্লাবের বর্তমান সভাপতি মোঃ শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ক্লাবের ভূৃমিকা নিয়ে স্মৃতিচারণ করে বলেন, তারা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যেকোন সময় দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক পড়বে। ঠিক এক থেকে দেড় মাস আগেই ওই ক্লাবে মিলিত হয়ে স্থানীয় যুবকরা সংগঠিত হতে থাকে এবং অনেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলেন৷ যেখানে তাদের নেতৃত্ব দেয় তারই বড় ভাই এবং প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত ডাঃ মোঃ শাহ আলম চৌধুরী। এই সবুজ সংঘ ক্লাবের ব্যানারেই তখন আন্দোলন সংগ্রামের সূচনা করা হয়। সেখান থেকেই তৎকালীন চন্দ্রঘোনার বাসিন্দা বীর প্রতীক একেএম ইসহাক, মোঃ আজিম সহ আরো সিনিয়র কয়েকজন মিলে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। তখন তারা প্রতিদিন মশাল মিছিল শেষ করে সবুজ সংঘে এসে আশ্রয় নিতেন এবং সেখানেই পোস্টার তৈরি সহ নানা কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। পরে সবুজ সংঘ থেকে পাশের ম্যাটারনিটি সেন্টারকে সদর দপ্তর হিসেবে বেছে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তখন সিনিয়রদের পাশাপাশি উনি এবং তার সহযোদ্ধা রমজান আলী, মোঃ বাদশা, সিরাজুল ইসলাম বাঙালি সহ আরো কয়েকজন একসাথে সংগঠিত হন। তখন তারা সিনিয়রদের আদেশে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করতেন।
সেসব স্মৃতি তুলে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণার আরও আগে থেকেই বীর উত্তম ডাঃ শাহ আলম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মনসুর (বাবলু) দুইটি কাপড়ের তৈরী বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত পতাকা, এক বান্ডেল নিউজ প্রিন্টে লেখা জাতীয় সংগীত ও পতাকা প্রিন্ট করে নিয়ে এসে সংগ্রহে রেখেছিলেন। যা পরবর্তীতে লিডার মাহাফুজ, সাবের আজম আজমেরি, এসএম ইউসুফ, ইন্দ্র নন্দন দত্ত ও তার সংগ্রহে ছিলো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী একটি অপরেশনের স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, তিনি এবং আরও দুইতিন জন সহযোদ্ধা এই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই চন্দ্রঘোনাস্থ কেপিএম এলাকার ১৪ নং বাংলোয় একটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেসময় সেখানকার পাহাড়ের ওপর একটি বড় ওয়ারলেস টাওয়ার ছিলো। যার মাধ্যমে পাকিস্তানিরা যোগাযোগ করতো। সেই টাওয়ারটির মেশিন তারা জব্দ করে নিয়ে আসেন। এবং সেখানে দায়িত্বরত দু’জন প্রহরীকে অজ্ঞান করেই এই কার্যক্রম সংঘঠিত করেন। এতে করে পাকিস্তানীদের যোগাযোগের ব্যবস্থা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। এরকম নানা স্মৃতির কথা তিনি তুলে ধরেন।
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই মুক্তিযুদ্ধেই অবদান রেখে আসছিল ৫৮ বছরের পুরানো চন্দ্রঘোনার ঐতিহাসিক সবুজ সংঘ ক্লাবটি। তবে দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় বয়সের ভারে জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে ক্লাবটি। দরজা, জানালা সহ উপরের টিনের চাল খসে পড়ছে। অনেকটা অবহেলিত ও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে ঐতিহাসিক ক্লাবটি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই সবুজ সংঘ ক্লাবটিকে সংরক্ষণ সহ এর উন্নয়নে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানায় এলাকার সচেতন নাগরিকরা।


