রমজানুল মোবারক কে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ১০ দিন রহমতের। এই সময়ে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হতে থাকে। আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে আল্লাহর রহমত। রহমত ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচার উপায় নেই। তবে পবিত্র রমজানের প্রথম দশকে রহমতের বারিধারা আরও প্রবল বেগে বইতে থাকে। এতে সিক্ত হয়ে মুমিন বান্দারা পরকালে সুউচ্চ আসনে আসীন হতে পারেন। রমজান মাস। আরবি মাসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস। দীর্ঘ দুটি মাসের নিরন্তর দোয়া ও প্রার্থনা ছিল হে আল্লাহ রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমাদান আমাদের নসিব করুন! এই দোয়া কবুল হলো আজ তা বাস্তবে পরিণত হলো। তাই আনন্দ চিত্তে সুস্বাগত জানাচ্ছি মহিমান্বিত মাহে রমাদানকে আহলান সাহলান ইয়া মাহে রমাদান বা সুস্বাগত মাহে রমাদান। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : যখন রমাদান মাস আসে তখন বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয় দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় ; শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। রমজান শব্দের অর্থ দহন করা। মুসলমানদের পাপ-পঙ্কিলতা জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দিতে আগমন ঘটে মাহে রমজানের। মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ মাসের নাম রমজান। রমজান মাসে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মহান রাব্বুল আলামিন। একজন মুসলমানের জন্য অন্যান্য ফরজ ইবাদতের মতো রোজা রাখা আবশ্যক। ইসলামের মূল পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম এটি।
পবিত্র রমজান মাস রহমতের মাস। প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন রমজান মাসের প্রথম ১০ দিন হলো রহমত ; তার দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত ; এর শেষ ১০ দিন হলো নাজাত। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে প্রথম ১০ দিন আল্লাহতাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমত বা দয়া বণ্টন ও বিতরণ করতে থাকবেন। দ্বিতীয় ১০ দিন আল্লাহতাআলা তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে থাকবেন। শেষ ১০ দিন আল্লাহতাআলা তাঁর বান্দাদের জাহান্নাম থেকে নাজাত বা মুক্তি দিতে থাকবেন। বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিসে হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন সিয়াম এবং কোরআন হাশরের ময়দানে বান্দা-বান্দীর জন্য সুপারিশ করবে এবং আল্লাহ্তাআলা তঁদের উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) আরও বর্ণনা করেন রাসুলে পাক (সা.) বর্ণনা করেন প্রত্যেক বস্তুর জাকাত রয়েছে তেমনি শরীরেরও জাকাত আছে আর শরীরের জাকাত হচ্ছে রোজা পালন করা। অর্থাৎ জাকাতদানে যেভাবে মালের পবিত্রতা অর্জন হয় তেমনি রোজা পালনের মাধ্যমে শরীর পবিত্র হয় গুনাহ মুক্ত হয়। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন মানুষের প্রত্যেক আমলের সওয়াব দশ গুণ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। হাদিসে কুদসিতে আছে আল্লাহ্তাআলা বলেন রোজা এ নিয়মের ব্যতিক্রম কেননা তা বিশেষভাবে আমার জন্য আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দেব বান্দা তার পানাহার ও কামনা– বাসনাকে আমার সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছে।
পবিত্র রমজান মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছিল। আল্লাহতাআলা বলেন রমজান মাস যে মাসে নাজিল করা হয়েছে আল– কোরআন মানুষের জন্য হিদায়াত রূপে এবং পথনির্দেশনার প্রমাণ ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য নির্ণয়কারী হিসেবে (সুরা-২ বাকারা, আয়াত : ২৮৫)। কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব যা সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) –এর ওপর নাজিল হয়েছে। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত আর নতুন কোনো কিতাব ও নতুন কোনো নবী বা রাসুল আসবেন না ; এটিই কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের জন্য দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ। রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস। আর সিয়াম সাধনা বা রোজা পালন তাকওয়া অর্জনের অনন্য সোপান। রমজানে মাসব্যাপী রোজা পালন ফরজ করার তাৎপর্য এখানেই নিহিত। আল্লাহতাআলা বলেন হে মুমিনগণ তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য ফরজ করা হয়েছিল ; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সুরা বাকারা-আয়াত : ১৮৩)। হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। এ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্যরাও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইবে। কিন্তু রোজাদার ব্যতীত অন্য কাউকে এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন রাসুল পাক (সা.) ইরশাদ করেন রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে একটি তার ইফতারের সময় অপরটি হলো আল্লাহ্তাআলার দিদার বা সাক্ষাতের সময়। হাদিসে আরও উল্লেখ রয়েছে ইফতারের সময় দোয়া কবুলের সময়। আল্লাহ্তায়ালা বান্দার দোয়া কবুল করেন। আর এই সময়ের দোয়া হচ্ছে–আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিরাহমাতিকাল্লাতি ওয়াসিয়াত কুল্লা শাইয়িন আনতাগফিরা লিজুনুবি। এশার সালাতের (ফরজ ও সুন্নতের) পর বিতরের আগে দুই রাকাত করে মোট ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। সম্ভব হলে খতম তারাবি আদায় করবে। রমজান মাসের বিশেষ ইবাদত হলো তারাবিহর নামাজ। নবী করিম (সা.)-বলেন যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে তারাবিহ নামাজ পড়বে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে (বুখারি, হাদিস : ৩৬)। রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। তারাবিহর নামাজের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য কোরআন তিলাওয়াত করা ও শোনা। এ নামাজে পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার পাঠ করা সুন্নাত। একে খতম তারাবিহ বলা হয়।
লাইলাতুল কদর হচ্ছে একমনে একটি রাত যে রাতে জেগে ইবাদত-বন্দেগি করলে এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। এক হাজার মাসের হিসাব করলে কদরের এক রাতের ইবাদত ৮৬ বছর ৪ মাসের সমান। কিন্তু আল্লাহ্তাআলা তার চেয়েও বেশি বা উত্তম বলেছেন। যে ব্যক্তি কদরের রাতে সওয়ারের আশায় ইবাদত করবে তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আমি যদি কদরের রাত্রি পাই তাহলে আমি কী দোয়া পড়ব ? আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফুআন্নি এই দোয়া পড়বে। হাদিসে আছে তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখ) শবে কদর তালাশ করবে।
আল্লাহ্তাআলা ইরশাদ করেন ওয়া আনতুম আকিফুনা ফিল মাসজিদ তোমরা মসজিদে ইতিকাফ করো। ইতিকাফ শব্দের অর্থ নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় শর্ত সাপেক্ষে নিয়তসহকারে পুরুষেরা মসজিদে ও নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা। রমজানের শেষ দশক (২০ রমজান থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে শাওয়াল মাসের চঁদ দেখা পর্যন্ত) ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। বিনা প্রয়োজনে অর্থাৎ গোসল খাবার প্রস্রাব-পায়খানা ব্যতীত অন্য কোনো অজুহাতে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করতে পারবে না। ইতিকাফ অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত জিকির নফল নামাজ ইত্যাদিতে মশগুল থাকবে। প্রকৃতপক্ষে রমজান হলো পূর্বের সকল গুনাহর জন্য ক্ষমা চেয়ে সাচ্চা মুসলমান হয়ে জীবনযাপনের প্রতিজ্ঞা করার মাস। এ মাসের সময়গুলো খুব বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করা উচিত। সদকাতুল ফিতর রমজান মাসে দিতে হয় এমন একটি অনুদান। যাতে মুসলিম সমাজের অভাবী ব্যক্তিরাও যেন স্বাচ্ছন্দে ঈদ উদযাপন করতে পারে। ঈদের নামাজের পূর্বেই এই সদকা আদায় করতে হয়। সাহাবায়ে কেরাম ঈদের বেশ কয়েক দিন পূর্বে অভাবীদের কাছে এ সদকা পৌঁছে দিতেন। যাতে তারা ঈদের জামা-কাপড় এবং বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটা করে খুশি মনে ঈদ উদযাপন করতে পারে। প্রথম দশকে আমরা কোরআনে বর্ণিত একটি দোয়া বেশি বেশি পাঠ করতে পারি। উচ্চারণ : ওয়া কুর রব্বিগফির ওয়ার হাম ওয়া আনতা খইরুর রহিমিন। অর্থাৎ : আর বলুন, হে আমার রব! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন, আর আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। (সুরা মুমিনুন-১১৮)
আল্লাহপাক এর মহান বাণী পবিত্র আল কুরআনসহ আসমানী কিতাবসমূহ এই মাসে নাজিল হয়েছে। এই মাসেই রয়েছে পবিত্র লাইলাতুল কদর। যার মূল্য হাজার মাস ইবাদতের ঊর্ধ্বে। এই মাসের প্রথম দশ দিন রহমতের বারিধারায় অবগাহন দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাত ও ক্ষমার আলোকে উদ্ভাসিত, আর শেষ দশ দিন জাহান্নাম হতে মুক্তি ও নিষ্কৃতির সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ লাভ করে ধন্য হওয়ার কামনা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের অন্তরে থাকা প্রয়োজন।
মুমিনদের জীবনে মাহে রমজান আসে রহমত ও বরকতের সুসংবাদ নিয়ে। পবিত্র এই মাসে মুমিনরা সংযম ও সহনশীলতার উত্তম অনুশীলন করে থাকে। আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য দিনের বেলা পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকে। তাই এই মাসে আল্লাহতায়ালাও তার মুমিন বান্দাদের প্রতি অঝোর ধারায় রহমত ও বরকত বর্ষণ করেন। বলা হয়ে থাকে আল্লাহর দান ও প্রতিদান লাভের জন্য এই মাসের চেয়ে মোক্ষম সময় ও অবারিত সুযোগ বান্দা আর কখনও পায় না। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত লাভে তাওফিক দান করুন। আমিন। ইয়া রাব্বুল আলামিন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট