রমজান মাস শেষ হয়ে এখন চলছে শাওয়াল মাস। ইবাদতের এক মৌসুম শেষ হয়ে আরেক মৌসুম শুরু হয়েছে। মুমিন রমজান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে রমজান-পরবর্তী মাসেও তা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। যার ফলে জীবন গড়ে ওঠে আল্লাহভীতির আদর্শের রঙে। তাই তারা রমজানের রোজার মতো নফল রোজা পালনেও থাকে যতনবান। আর আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মদির ওপর বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। অল্প আমল করে বেশি সওয়াব বেশি মর্যাদা অর্জন করার তাওফিক দিয়েছেন। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে যে ব্যক্তি কোনো পুণ্য নিয়ে আসবে তার জন্য অনুরূপ তার দশগুণ (সওয়াব) রয়েছে। আর যে ব্যক্তি কোনো অসৎকর্ম নিয়ে আসবে তাকে কেবল তারই সমান প্রতিফল দেয়া হবে। আর তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না। (সূরা আনআম : ১৬০)। আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন নির্ধারিত সময় মানুষ দুনিয়াতে অবস্থান করবে। এ সময়টি পরকালের শস্যক্ষেত্র। যারা এখানে ভালো কাজ করবে তারাই ভালো ফল পাবে। আর যারা মন্দ কাজ করবে তারাও এর প্রতিফল পাবে। সুতরাং প্রতি সপ্তাহ মাস ও বছরের আমলগুলো যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমে হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলা খুবই জরুরি। এ ছাড়া মানুষের মৃত্যুর পর যেন সওয়াবের পথ বন্ধ হয়ে না যায় সে জন্য বিশেষ তিনটি আমল অব্যাহত রাখা। এ জন্য সপ্তাহ মাস ও বছর হিসাব করার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিনই বিশেষ তিনটি আমল করা জরুরি। হাদিসে এসেছে-নবীজি সা: বলেছেন মানুষের মৃত্যুর পর তিনটি আমল ছাড়া সব রকমের আমলই বন্ধ হয়ে যায়। তাহলো : ১. সদকায়ে জারিয়া ; ২. উপকারী ইলম বা জ্ঞান ও ৩. এমন নেক সন্তান যে তার (মৃত্যুর পর তার) জন্য দোয়া করতে থাকে (মুসলিম)।
সদকায়ে জারিয়া : যার অর্থ এমন ধরনের জনকল্যাণকর কাজে ব্যয় হয় যার সুফল বহু দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। মানুষ এ কাজে উপকার পেয়ে থাকে। যেমন-পুকুর কাটা, কূপ খনন করা বা পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করা, মুসাফিরদের জন্য সরাইখানা তৈরি করা রাস্তার পাশে ছায়াদানকারী বৃক্ষ রোপণ করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করে যাওয়া, রাস্তাঘাট নির্মাণ বা ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি করা।
উপকারী জ্ঞান : এমন জ্ঞানমূলক বই-পুস্তক লেখা, যার মাধ্যমে লোকেরা সঠিক পথের সন্ধান লাভ করবে। কল্যাণের পথে পরিচালিত হবে। দুনিয়া ও পরকালের যাবতীয় জ্ঞান লাভে জীবন সাজাতে পারবে। কিংবা মৃতব্যক্তি কাউকে এমন কিছু শেখায় যে তার ফলেও সে প্রতিদান পেতে থাকবে।
নেক সন্তান : তৃতীয় যে কাজটির জন্য মৃত্যুর পরও সে প্রতিদান পেতে থাকবে তা হলো তার নেক সন্তান, যাকে সে প্রথম থেকেই সুশিক্ষা দিয়েছে এবং তার চেষ্টার ফলেই সে আল্লাহভীরু ও দ্বীনদার হতে পেরেছে। যতদিন পর্যন্ত এমন নেক সন্তান দুনিয়ায় জীবিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত তার কৃত সৎকাজের সওয়াব সেও পেতে থাকবে। এমনকি সে সন্তান বাবা-মায়ের কথা স্মরণ করে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে বলবে-উচ্চারণ : রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা (সূরা বনি ইসরাইল,আয়াত-২৪)। অর্থ : হে আমার প্রভু! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। সুতরাং আমাদের রমজানের আমলগুলো যেন এমন হয় যে রমজান পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে জীবন পরিচালনায় সহায়ক হয়। এমনকি মৃত্যুর পরও যেন তা আমাদের জন্য সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। বছরজুড়ে এ কাজগুলোও করা যেতে পারে :-
১. নিয়মিত বাবা-মায়ের সেবা করা।
২. প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেয়া।
৩. অসহায় মানুষের ঘরে ঈদ উপহার ও পরবর্তী সময় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া।
৪. বিপদ-আপদে অন্যের পাশে দাঁড়ানো।
৫. অহঙ্কার-দম্ভ পরিহার করা।
৬. পাপ কাজ থেকে দূরে থাকা।
৭. লেনদেনে সততা অবলম্বন করা।
৮. অন্যের সম্পদ দখল করা থেকে বিরত থাকা।
৯. কখনো মিথ্যা কথা না বলা।
একজন মুমিন কোনো উৎসব বা আনন্দ নিজের মন মতো করবেনা। কারণ মনের চাহিদা পূরণের সুখ অস্থায়ী ও ক্ষণিকের। আর মুমিন তো অস্থায়ী বা ক্ষণিকের সুখ নয় বরং সে প্রত্যাশা করে জান্নাতের অনাবিল সুখ ও শান্তির। আর বড কানো অর্জন কি সবোর্চ্চ ত্যাগ ও কঠোর সাধনা ছাডা সম্ভব ? পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত। (সূরা হিজর : ৯৯) রমজান পরবর্তী মুমিনদের জীবন কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে আজকের আলোচনা :-
আল্লাহর ভয় ধারণ করা : রোজার প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। রমজান পরবর্তী জীবনে যদি আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করে চলা যায় তবে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা সার্থক বলে গণ্য হবে। আর আল্লাহভীতিই মুমিন জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ প্রশস্ত করে দেন এবং তাকে ধারণাতীত উৎস থেকে জীবিকা দান করেন। (সূরা তালাক,আয়াত : ২-৩)
আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা : রমজান হলো মুমিনের জন্য ভালো কাজের প্রশিক্ষণ নেওয়ার মাস। সে এই মাসে তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং ভালো কাজ করা ও মন্দ কাজ পরিহারের অভ্যাস করবে বছরের অবশিষ্ট দিনগুলোতে সে অনুযায়ী জীবনযাপন করবে। রমজান মাসে যেসব নেক আমল করা হতো তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করা : সমাজের অনেককে দেখা যায় রমজান মাসে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে এবং রমজানের পর মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না এটি নিন্দনীয়। মসজিদে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা সব সময়ের জন্য আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সা: সেসব মানুষের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যারা মসজিদে উপস্থিত না হয়ে ঘরে নামাজ আদায় করে।
পাপ কাজে ফিরে না যাওয়া : পাপ কাজ পরিহার করার পর আবার তাতে লিপ্ত হওয়া আল্লাহর দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয়। আল্লাহ কুরআনের একাধিক স্থানে এই শ্রেণির মানুষের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে তোমরা সেই নারীর মতো হইও না যে তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর তা খুলে নষ্ট করে দেয়। (সূরা নাহল, আয়াত : ৯২)
আল্লাহর ওপর ভরসা করা : তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসা করার অর্থ হলো,দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় বিষয়ের কল্যাণ লাভ ও ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য সঠিকভাবে অন্তর থেকে আল্লাহর ওপর নির্ভর করা। বান্দা তার প্রতিটি বিষয় আল্লাহর ওপর সোপর্দ করবে।
হালাল রোজগার করা : ইসলাম হালাল উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করার নির্দেশ দেয়। এমনকি ফরজ ইবাদতের পর হালাল পন্থায় উপার্জন করাকে ফরজ সাব্যস্ত করা হয়েছে। রাসূল সা: বলেন ফরজ আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরজ (বায়হাকি)। যে শরীর হারাম খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তা জান্নাতে যাবে না।
জুলুম না করা : মানুষের ওপর অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন এমন অপরাধ দুনিয়ার জীবনেই মানুষ যার শাস্তি পেয়ে যায়। শুধু মানুষ নয় পশুপাখির ওপরও জুলুম করা হারাম। জুলুম ভয়াবহ অপরাধ। এই অপরাধে দুনিয়ার শাস্তির পাশাপাশি পরকালে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন জালিমরা শিগগিরই জানবে কোথায় তারা প্রত্যাবর্তন করবে।
নফল নামাজ আদায় করা : ফরজ নামাজের পর নফল নামাজের রয়েছে অনেক গুরুত্ব। নবী সা: সুস্থতা-অসুস্থতা, সফর-নিবাস, নিরাপত্তা-যুদ্ধ সব সময় ফরজের পাশাপাশি যতবান ছিলেন নফল নামাজেও। নফল নামাজ মহান আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। ফরজে হয়ে যাওয়া ত্রুটির ক্ষতিপূরণ হয়।
কোরআন তিলাওয়াত করা : রাসুলুল্লাহ সা: থেকে পরবর্তী যুগের সব মনীষী রমজান মাসে কুরআন চর্চা বাড়িয়ে দিলেও বছরের কোনো সময় তাঁরা কুরআন চর্চা থেকে একেবারেই বিরত থাকতেন না। ইসলামী আইনজ্ঞরা কুরআন থেকে বিমুখ হওয়াকে হারাম বলেছেন।
নফল রোজা রাখা : রমজানের পর রাসূলুল্লাহ সা: শাওয়াল মাসে গুরুত্বের সাথে ছয় রোজা পালন করতেন। একাধিক বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা শাওয়ালের ছয় রোজার মর্যাদা ও ফজিলত প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল অতঃপর তার সাথে সাথে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখল সে যেন পূর্ণ বছরই রোজা রাখল।
দান-সদকা করা : রমজানে অন্যান্য ইবাদতের পাশাপাশি দান-সদকার প্রতি মুসলমানরা বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। সবাই নিজ নিজ সাধ্যমতো দান করে। অনেকে এই মাসে জাকাত আদায় করে থাকে। ঈদুল ফিতরে সদকায়ে ফিতর আদায় করে। এই সময়ে অনেকে বিভিন্ন দ্বিনি কাজে আর্থিকভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। কিন্তু গরিব-দুঃখীর প্রতি সহমর্মিতা দেখানো সম্পদের হক আদায় করা ও দ্বিনের সাহায্য করা শুধু রমজানের আমল নয়।
মুমিন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘তাকওয়া’ বা ‘আল্লাহভীতি’। আমার প্রতিটি কাজ প্রতিটি পদক্ষেপ মহান আল্লাহ সর্বদা দেখছেন। প্রতিটি কর্মের জন্য তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে-এ অনুভূতি সর্বদা মনে দৃঢ়ভাবে জাগ্রত রাখা এবং মহান রবের সব ধরনের আদেশ-নিষেধগুলো মেনে চলাই হলো তাকওয়া। মহান আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে দামি যে তাকওয়াবান। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানী যে অধিক মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) (সুরা হুজুরাত : ১৩)। রমজান শেষ হলেও রমজানের প্রভাব যেন ধরে রাখতে পারি বাকি এগারোটি মাস আল্লাহর কাছে সে প্রার্থনা করি। আল্লাহ সবাইকে ভালো কাজের ধারা অব্যাহত রাখার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
রমজান-পরবর্তী মুমিনের জীবন হোক তাকওয়ার আলোয় আলোকিত
সংবাদটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন