ঋণ, বিশৃঙ্খলাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে স্বনির্ভর করার মাধ্যমে ক্লিন, গ্রিন, হেলদি সিটি হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
৫ নভেম্বর (মঙ্গলবার) লালদীঘিপাড়স্থ দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের কনফারেন্স রুমে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এ মন্তব্য করেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত চসিককে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় নিয়ে মেয়র বলেন, আজকের এই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অর্গানোগ্রামে যেখানে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা ছিল, সেখানে হয়ে গেছে প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার। আজ আমি যখন দায়িত্ব নিচ্ছি আমার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বলছেন যে, আমি প্রায় ৪৪০ কোটি টাকা একটি ঘাটতি ঋণের বোঝা নিয়ে দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছি। আমাকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ করতে হবে।
“আমি একসময় চট্টগ্রামের রেড ক্রিসেন্ট এর চেয়ারম্যান ছিলাম। এই প্রতিষ্ঠানে যখন আমি দায়িত্ব নেই সেসময় ছোট এই প্রতিষ্ঠানটি ঋণে জর্জরিত ছিল। আমি যখন বেরিয়ে আসি তখন প্রায় ৪ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রেখে আসছি এবং একটি নতুন ভবন তৈরি করে দিয়েছি। কাজেই আমি আপনাদেরকে আশা দিতে চাই আপনারা অত্যন্ত সততার সাথে দুর্নীতি মুক্তভাবে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আমার সাথে কাজ করবেন, আপনাদের সমস্ত চ্যালেঞ্জ আমি নিলাম। এই সিটি কর্পোরেশন একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসাবে আমি আপনাদেরকে উপহার দিবো ইনশাআল্লাহ।”
মেয়র আরো বলেন, চট্টগ্রাম বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। এই চট্টগ্রাম শুধু আমার একার নয়; এই চট্টগ্রাম আমাদের সবার। এই স্লোগান দিয়ে আমি আমার কার্যক্রম শুরু করব। আমাদেরকে চট্টগ্রামের প্রতি মমত্ববোধ ভালোবাসা থাকতে হবে। তখনই আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, হেলদি সিটি উপহার দিতে পারব। যেটি আমার নির্বাচনী ইশতেহারে আপনারা দেখেছেন।
“আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই। আমি অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ৪১ ওয়ার্ডে প্রোগ্রাম দিবো। আমাদের এখন প্রধান যে সমস্যা সেটা হচ্ছে আমাদেরকে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের পাশাপাশি সমস্ত নাগরিককে সচেতন করার লক্ষ্যে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিসহ মশা নিধন করা হবে। লার্ভিসাইড কিলিং করার যে স্প্রে করা হয়, আমি যখন এসেছি এই লার্ভিসাইডের কোয়ালিটি একটু টেস্ট করতে চাই। এমন কোন স্প্রে আমি চাই না যে স্প্রে দিয়ে মশা লাফ দিয়ে উঠে যাবে এবং মশা মরছে কিনা সেটা দেখতে হবে। মশা না মরলে এই ধরনের ওষুধ কিন্তু আমি গ্রহণ করব না।”
তিনি বলেন, আমি নিজেই স্পটে যাব। আমি কিন্তু সকালে এখানে বেশিক্ষণ থাকবো না। দুুই থেকে তিন ঘন্টা অফিসে থাকবো। এরপর আমি বেরিয়ে যাবো একদিন এক-এক ওয়ার্ডে পরিদর্শন করবো। আমার সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানের লোকজন এবং ডেঙ্গু সেল নিয়ে কাজ করছেন তারাও থাকবেন। আমি প্রতিটা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরবো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম নিজে প্রত্যক্ষ করবো। একটু আগে শুনেছি পরিচ্ছন্ন বিভাগে প্রায় ২ হাজার কর্মচারী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত। আমি প্রতিটা ওয়ার্ডে গিয়ে স্বশরীরে তাদের দেখতে চাই। আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি যদি কাউকে আমি না দেখি তাদের চাকরি হয়তোবা নাও থাকতে পারে। আমাকে অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। কারণ আমি বারবার বলছি আমি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি রাজনীতিবিদ তবে সে রাজনীতি সিটি কর্পোরেশনের বাইরে। আমি আমার সমস্ত নেতাকর্মীদের এখানে অনেকেই আছে তাদের আমি বলতে চাই আপনারা আমাকে কাজের সময় ডিস্টার্ব করবেন না। আপনাদের সাথে আমি রাজনীতি করব সন্ধ্যা ৫টা’র পর। ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কোন ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ আলাপ-আলোচনা নিয়ে আমার কাছে আসবেন না। আমি এটা স্পষ্ট করে বলছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয় একজন সদালাপী, অত্যন্ত কর্মঠ লোক। গত কয়েকদিন আমি মন্ত্রণালয়ে উনার সাথে সময় কাটিয়েছি যদিও সেখানে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থাকার কথা। ৮৫ বছরের বয়স্ক একজন লোক দিনরাত কষ্ট করে যাচ্ছেন এবং রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন। গতকালও রাত ৮টা পর্যন্ত আমাদের সাথে ডেঙ্গু নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছে কাজেই এত বয়সে যদি একজন লোক যদি কষ্ট করতে পারে আমরা কম বয়সে কেন কাজ করতে পারবোনা।
তিনি বলেন, আমাদের সবাইকে কাজের প্রতি সিনসিয়ারিটি এবং কাজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। তাই আজকে আমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের উপর জোর দিতে চাচ্ছি। প্রথমে একটা ক্লিন সিটিতে রূপান্তর করতে চাই। আমি বলতে চাই যে দোকান ও প্রতিষ্ঠানের সামনে ময়লা আবর্জনা পাওয়া যাবে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে। তিনি চসিক কর্মকর্তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সমস্ত বিন রেডি করে রাখার নির্দেশনা দেন। দোকানদাররা দোকানের সামনে একটা একটা বিন বসিয়ে দিবেন। দোকানদারগণ সেই বিনে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন। সবারই উচিত নিজের আঙ্গিনাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। আপনার সামনের যে উঠান আছে সে উঠান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব আপনাদের। আর বাকিগুলো আমি করব কাজেই আপনাদের দোকানের সামনে যদি কোন ময়লা পড়ে থাকে তাহলে আমি কিন্তু আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। আমার সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানের কর্মীরা এবং যারা কর্মকর্তারা আছে আপনারা সবাই থাকবেন। আমি রাজনীতি করেই বড় হয়েছি। কোন ভয়-ভীতি, ধমক এগুলি কেউ দিলে সেটা বোকার স্বর্গে বাস করবেন। কাজেই আমি সবাইকে বলছি যে প্লিজ দেশটাকে ভালোবাসুন। দেশের প্রতি মমত্ববোধ দেশের প্রতি ভালোবাসা দেশের প্রতি যদি আপনার সততা না থাকে আপনি নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তোলতে পারবেন না।
মেয়র বলেন, প্রথমে আমি নিজকে দিয়ে সংস্কার করতে হবে। আমি নিজের আত্মশুদ্ধি দিয়ে আমাকে শুরু করতে হবে। তাহলে দেখবেন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমরা করতে পারি আমরা জানি আমরা আসলে বাঙালিরা কর্মঠ আমরা কাজ করতে জানি। আসলে হয়েছি কি আমরা একটা সিস্টেমের মধ্যে পড়ে গেছি। যার কারণে আমরা আজকে সেটা করতে পারছি না। আমি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করবো। ইতিমধ্যেই সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় করার জন্য গত ১৫-২০ দিন ঢাকাতে অবস্থান করেছি। আমি বেশ কয়েকটি টকশো করেছি এবং এইসব মন্ত্রণালয়ের যারা উপদেষ্টা আছে তাদের কথা বলেছি যে এটার জন্য যে জিনিসটি খুবই দরকার সেটা হচ্ছে যে সিটি গভর্মেন্ট বা নগর সরকার। যদি সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে নগর সরকার হয় তাহলে সমস্ত সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হবে।
“হোল্ডিং ট্যাক্স যদি আমরা ঠিকমত পাই ইনশাআল্লাহ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বেতন দেওয়ার জন্য আর কোন সমস্যা হবে না কিন্তু ওই হোল্ডিং ট্যাক্সও আমরা কিন্তু পাচ্ছি না। বিভিন্ন কারণে অনেকেই হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছে। নাগরিকরা আপিল করতে করতে সমাধান না পেয়ে অনেকেই ৩০-৪০% কর দিচ্ছেন। মাঝখানে একটা গ্রুপ সেখানে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে কমিয়ে দেওয়ার কথা বলে এদিক ওদিক করে টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। সিটি কর্পোরেশনকে আপনারা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে যাবেন না। এ বিষয়টার সমাধান করতে হবে।”
প্রত্যেক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ করতে চান জানিয়ে মেয়র বলেন, শহরে খেলার মাঠ নেই। ফলে, এক পর্যায়ে টার্ফ তৈরি হল। আজকে যে টার্ফ তৈরি হয়েছে এটা সমাজের মধ্যে একটা বৈষম্য তৈরি করছে। গরীব বাচ্চারা কিন্তু সেখানে খেলতে পারছে না। এতে তাদের মনের মধ্যে যে সাইকোলজিকাল ডেমোরাইজ হয়ে যাচ্ছে এ কথাটা কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না। এই জিনিসগুলোর বিষয়ে কিন্তু আমাদেরকে মানবিক হতে হবে। আমাদেরকে এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমি অবশ্যই এদিক দিয়ে নজর দিব। আজকে আমরা এই ছোট্ট একটা মোবাইলের মধ্যে আমাদের চোখ চলে গেছে। সারাক্ষণ সেখানে আমরা দুই চোখ দিয়ে রাখছি। এইটার কারণে আমাদের চোখ-কান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নার্ভের সমস্যা হচ্ছে, বাচ্চাগুলো এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সোসাইটির সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। আমার মনে হয় ভেরি ইম্পর্টেন্ট প্রতিটা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একটা একটা খেলার মাঠ তৈরি করতে হবে।
চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগকে ঢেলে সাজানো হবে জানিয়ে মেয়র বলেন, একসময় দেখতাম যে মেমন হাসপাতালে প্রচুর রোগী চাইল্ড এন্ড ম্যাটারনাল ফ্যাসিলিটিস এর জন্য আসত। এটা চট্টগ্রামে এক নাম্বার ছিল। আমি ওই এক নাম্বার জায়গায় মেমন হসপিটালকে নিতে চাই এবং ৪১ ওয়ার্ডে যেসব ছোট ছোট হেলথ রিলেটেড সেন্টার গুলো আছে, ডিসপেন্সারি; এগুলো আরো একটিভ করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে একটা ছোট্ট ছোট অপারেশন থিয়েটার করে দিয়ে, ছোট ছোট যে সার্জারি গুলো হয় সেগুলো আমরা সেখানে করতে পারি। আমি বলছি আমি যাব, আমি হাটবো কোন সমস্যা নাই। আমি সময় দিব। সিটি কর্পোরেশনকে আমি একটা পরিবর্তনের জায়গায় নিয়ে আসতে চাই।
শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে মেয়র বলেন, আপনারা জানেন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের টাকা দিয়ে করা। আজকে সেটা দখল হয়ে গেছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধার করব ইনশাল্লাহ। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি সেটা আমি করব। গত ১৬ টি বছর যেটা হয়েছে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়নি। আপনি অনেক শিক্ষিত যুবককে জিজ্ঞেস করবেন একটা ইংরেজি বানান, পারবেনা। শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে এটার কোন বিকল্প নাই। শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে নৈতিক শিক্ষায় সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। আমরা চাই একটি মেধাবী জাতি তৈরি করে দিতে। আজকে যে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনটা হয়েছে সেটা হচ্ছে মেধার যে একটা বৈষম্য এসেছে যে আমি মেধাবী আমি চান্স পাচ্ছি না, আর একটা অমেধাবী রাজনৈতিক কারণে সে চান্স পেয়ে যাচ্ছে। এই কারণেই কিন্তু আজকে এই যুদ্ধটা হয়েছে। কাজেই এটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। আমাদেরকে একটা মেধাবী জাতি তৈরি করতে হলে ডায়েট নিউট্রিশন ইজ ভেরি ইম্পরটেন্ট। এগুলোই কিন্তু আমাদেরকে প্রতিটি স্কুলে শিখাতে হবে।
মেয়রের সাথে দিনব্যাপি কার্যক্রমে ছিলেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব মো. আশরাফুল আমিন, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমি, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবুল কাশেম, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরী, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মো. ইমাম হোসেন রানাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, বিএনপি দলীয় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, এজাজ আহমেদ চৌধুরী আরজু।