ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পরেও রাজধানীর বাজারগুলোতে চিরচেনা চিত্র এখনো ফেরেনি। ক্রেতা তুলনামূলক কম। সেই হিসেবে পণ্যের সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও দাম বেশ চড়া। এরমধ্যে মুরগির দাম বেড়েছে আরেক দফা। ঈদের আগে গরু, খাসি ও মাছের বাড়তি দাম কমেনি এখনো। দাম বাড়ার তালিকায় যোগ হয়েছে আলু-পিয়াজ। কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিতেই ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে পিয়াজের দাম। তবে দুই/একটি সবজি ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দামও বাড়তি। গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজারসহ শান্তিনগর, মালিবাগ, সেগুনবাগিচা, মালিবাগ রেলগেইট বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর পাইকারি বাজারগুলোতে সবচেয়ে ভালো মানের হিসেবে বিক্রি হয় পাবনা থেকে আসা পিয়াজ। তাই অন্য জেলার পিয়াজ থেকে এর দামও থাকে বেশি।
রাজধানীর কাওরান বাজারে ৪৭-৪৮ টাকা কেজি দরে পাবনা থেকে আসা পিয়াজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ফরিদপুর ও অন্য অঞ্চলের পিয়াজও পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৪ টাকা কেজি দরে। ঈদের পর থেকে এসব পিয়াজে ৮-১০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, তীব্র দাবদাহের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য পিয়াজে। দেশে শিলাবৃষ্টির কারণে অনেক পিয়াজ নষ্ট হয়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ভারত থেকে পিয়াজ আমদানি না হওয়াকেও দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।
কাওরান বাজারে পিয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, এবার বৃষ্টির সঙ্গে অনেক শিল পড়েছে। এই কারণে অনেক পিয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া ভারত থেকেও কোনো পিয়াজ আসে না এখন। একই কথা বলেন, মনির হোসেন নামের কাওরান বাজারের আরেক পাইকারি পিয়াজ ব্যবসায়ী। তিনি জানান, গত এক-দেড় মাস ধরে ভারতের পিয়াজ আসে না। দেশে যে পিয়াজ উৎপাদন হইছে তাই বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে শিলাবৃষ্টিতে পিয়াজ নষ্ট হওয়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে। তাছাড়া এখন পিয়াজের ভরা মৌসুম শেষ হয়েছে।
আরেক পাইকার চাঁন মিয়া বলেন, ঈদের আগে পাল্লা (পাঁচ কেজি) ছিল ১৬০-১৭০ টাকা। এখন ২২০। পিয়াজ অনেক রকমের আছে জানিয়ে তিনি বলেন, গড়ে পিয়াজের দাম কেজি প্রতি ৪৭-৪৮ টাকা এখন।
এদিকে খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি পিয়াজে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫৫ টাকায়। পিয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ শেষে আমদানি ও পাইকারি বাজারের কার্যক্রম স্বাভাবিক না হওয়ায় আড়তে মালের সংকট রয়েছে। আবার সব দোকান না খোলায় পাইকারও কম। সেজন্য পণ্যের দাম বাড়ছে।
অন্যদিকে উৎপাদন ভালো থাকায় আগামী কোরবানির ঈদসহ পরবর্তী সময় পিয়াজ আমদানি বন্ধ থাকলেও বাজারে কোনো সমস্যা হবে না বলে দাবি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি’র বাজার দর অনুযায়ী, দেশি পিয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পিয়াজের কেজিতে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮.৫৭ শতাংশ। আর আমদানি করা পিয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে এই পিয়াজের কেজিতে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১১.৭৬ শতাংশ।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য বলছে, এ বছর বিরূপ আবহাওয়ায় হেক্টরপ্রতি পিয়াজের ফলন গতবারের তুলনায় অনেক কম হয়েছে। গত বছর হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৪.১৭ টন পিয়াজের ফলন হলেও এ বছর ১৩.৬০ টনের বেশি ফলন পাওয়া যায়নি। ফলে সারা দেশে সামগ্রিকভাবে পিয়াজের উৎপাদন কমে গেছে। গত বছর (২০২১-২২) দেশে ২.৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে পিয়াজের আবাদ করে ৩৬.৪০ লাখ টন পিয়াজ উৎপাদিত হয়। এ বছর ২.৪৭ লাখ হেক্টর জমিতে পিয়াজের আবাদ হলেও এ পর্যন্ত ২.২০ লাখ হেক্টর জমির ফসল কর্তন করে ৩০ লাখ টন পিয়াজ উৎপাদিত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। পিয়াজের ফলন কম হওয়ায় গতবারের চেয়ে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন পিয়াজ কম পাওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।
এদিকে ঈদের আগে বেড়ে যাওয়া ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও চিনির দাম এখনো কমেনি। পাশাপাশি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে নানা পদের সবজির দামও। এখন বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৬০ টাকা দরে। যা ঈদের আগে বেড়েছিল। এরমধ্যে কয়েকদিন ৫-১০ টাকা ওঠানামা করেছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে গরুর মাংসের দাম সাড়ে ৭০০ থেকে বেড়ে ৮০০ টাকায় ঠেকেছে। এখন চাহিদা কমলেও কমেনি দাম। তবে মাছের বাজারে ক্রেতাদের উপস্থিতি এবং মাছের চাহিদা বেশি দেখা গেছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের অধিকাংশ দোকানে গরুর মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। তবে কিছু কিছু দোকানে ৭৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে খাসির মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়, সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকায় এবং কক লেয়ার (লাল) প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়।
ঈদের পর ক্রেতাদের মাঝে মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে সব ধরনের মাছের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চাষের কই প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, পাঙ্গাশ মাছ প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, তেঁলাপিয়া প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৬০ টাকা, রুই মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা, শিং মাছ প্রতি কেজি ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা, কাতল প্রতি কেজি ৩২০ টাকা, চিংড়ি প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজার করতে আসা হোসেন আলী বলেন, ঈদের পর ঢাকায় এসে প্রথম বাজার করতে এসেছি। এসে দেখলাম সব ধরনের মাছের দাম বেশি।
অন্যদিকে ঈদের আগে থেকে চলমান চিনির সংকট এখনো কাটেনি। চাহিদা স্বাভাবিক হয়ে এলেও এখনো সরকার নির্ধারিত থেকে বেশি দামেও কিনতে হচ্ছে পণ্যটি। যেসব দোকানে খোলা চিনি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। যদিও ৬ই এপ্রিল সরকার প্যাকেট চিনির কেজি ১০৯ টাকা, আর খোলা চিনির কেজি ১০৪ টাকা ঠিক করে দিয়েছিল। দাম প্রসঙ্গে খুচরা দোকানিরা জানিয়েছেন, ঈদের আগ থেকে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন পরিবেশকরা। আবার চিনি কিনতে হলে দোকানদারকে বাধ্যতামূলক আরও কয়েকটি পণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন পরিবেশকরা এমনটিও জানিয়েছেন মালিবাগ বাজারের কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা।
এদিকে বাজারে ক্রেতাদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম থাকলেও কমেনি সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। উল্টো কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শসা ও বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়। বাজারে কাঁচামরিচ ৮০-৯০ টাকা, করলা ৬০-৬৫, ঝিঙা-পটোল ও চিচিঙ্গা ৫০-৭০, টমেটো ৪৫-৫০, পেঁপে ৫৫-৬০, গাজর ৮০-১২০ ও কচুর লতি কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এ ছাড়া লাউ ও চালকুমড়া বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়, বাঁধাকপি প্রতি পিস ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে আকারভেদে লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৫০ টাকা। এ ছাড়া শাকের মধ্যে পাট শাক, ডাটা, লাল, ও কলমি শাক প্রতি আঁটি বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা, পুঁইশাক বিক্রি হচ্ছে ১৫, লাউশাক ২৫- ৩০ টাকা এবং পালং শাক আঁটি প্রতি ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবজি বিক্রেতা নাছির বলেন, বাজারে সরবরাহ যেমন কম, ক্রেতাও কম। তবে দাম কমে না। বরং অনেক সবজির দাম বেড়েছে। অধিকাংশ সবজিই আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে শসা ও লেবুর চাহিদা একটু বেশি। অন্য সবজির বাজার আগের মতোই রয়েছে।